বাংলাদেশ

জুলাই ঘোষণাপত্রে কী আছে, পড়ুন বিস্তারিত

Advertisement

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। এতে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র বিনির্মাণের নানা দিক উঠে এসেছে।

কোথায়, কীভাবে পাঠ করা হলো ঘোষণাপত্র

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত ‘৩৬ জুলাই উদ্‌যাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আজ ৫ আগস্ট ২০২৫, বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা ও পেশাজীবীরা।

এই ঘোষণাপত্র মূলত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, যেখানে বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, স্বাধীনতার চেতনা এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামোর নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কেন দরকার হলো ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’?

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বারবার দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্র হরণ হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটাধিকার হরণ, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং একচ্ছত্র শাসনের অভিযোগ উঠেছে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে শুরু হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, যা পরে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের সফলতায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগ করে। এর ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

ঘোষণাপত্রের মূল বিষয়বস্তু: কী আছে ২৮ দফা ঘোষণায়

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ একটি ২৮ দফার রাজনৈতিক দলিল, যেখানে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে। এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

১. গণতন্ত্র ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি

বলা হয়েছে, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ছাড়া কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা টেকসই নয়। অতীতের একদলীয় শাসন, বাকস্বাধীনতার দমন এবং বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ ন্যায্য ছিল না।

২. নির্বাচন ও সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সংবিধানের সংস্কার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

৩. মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা

বিগত সরকারের আমলে গুম, খুন, নির্যাতন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ প্রসঙ্গে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে এবং দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়েছে।

৪. শহীদদের স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থনে শহীদ হওয়া সকলকে জাতীয় বীর ঘোষণা এবং তাদের পরিবারকে আইনগত সুরক্ষা ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

৫. টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ

ঘোষণাপত্রে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত থাকে।

ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ঘোষণাপত্র পাঠের পর তা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কিছু দল একে ইতিহাসের সঠিক প্রতিফলন হিসেবে অভিহিত করেছে, আবার কেউ কেউ এটিকে ‘নতুন রাজনৈতিক ব্যাকরণ’ হিসেবে দেখছে।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহমুদ রেজা বলেন,
“এই ঘোষণাপত্র কেবল অতীত সংশোধনের প্রস্তাব নয়, বরং ভবিষ্যতের রূপরেখা। এটি একটি রেনেসাঁর ডাক।”

তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ঘোষণাপত্র নিয়ে আশাবাদ দেখা গেছে। শিক্ষার্থী মেহজাবীন বলেন,
“এই দলিল আমাদের বলছে, আমরা ভবিষ্যৎ গড়তে পারি—যদি ঐক্যবদ্ধ হই।”

ঘোষণাপত্র কি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দিক নির্ধারণ করবে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ধরণের ঘোষণাপত্র খুব কম দেখা গেছে, যা জনতার অভ্যুত্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপ নিতে চায়। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কাগজ নয়, বরং জনগণের আকাঙ্ক্ষার দলিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে তা দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা ঘটাবে। তবে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের ওপর।

“এই ঘোষণাপত্র কেবল অতীতের ভুল শুধরে নেওয়ার আহ্বান নয়, এটি ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা” — ড. মাহমুদ রেজা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ একদিকে জনগণের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের স্বীকৃতি, অন্যদিকে ভবিষ্যতের সুশাসনের রূপরেখা। এর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ নতুন করে গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রয়োগই আসল চ্যালেঞ্জ। জনগণের চোখ এখন সেই বাস্তবায়নের দিকেই।

এম আর এম – ০৭০২, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button