ছেলের স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষায় শহীদ আবু সাঈদের মা

৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা মনোয়ারা বেগম। ছেলের রক্তে গড়া নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন এখনো তার চোখে অপরিপূর্ণ।
ছেলের কবরের পাশে প্রতিদিন অপেক্ষা
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান শহীদ আবু সাঈদ। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চাকরির দাবিতে হওয়া ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। আজ, ৫ আগস্ট, সেই শহীদ সাঈদের আত্মত্যাগের এক বছর পূর্ণ হলো।
সকালের আলো ফোটার আগেই ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যান মা মনোয়ারা বেগম। হাতে থাকে ছেলের ব্যবহৃত শার্ট, চোখে কান্না, হৃদয়ে শূন্যতা। ছেলের সেই শেষ দিনের কথা মনে করে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন,
“আমার ছেলে যে স্বপ্ন নিয়ে জীবন দিল, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ আমি এখনো দেখি নাই। আমার একটাই আশা—ছেলের রক্ত বৃথা না যাক। যেন এ দেশে কোনো মায়ের বুক খালি না হয় আর।”
আন্দোলন থেকে শহীদ হওয়া
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শিক্ষিত তরুণরা ন্যায্য চাকরির দাবিতে রাস্তায় নামে। সারাদেশে একযোগে শুরু হয় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। রংপুরে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আবু সাঈদ, যিনি নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে রাজপথে নেমেছিলেন।
২৬ জুলাই, মিছিল চলাকালীন হঠাৎ পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই তাকে গুলি করা হয়। এই মৃত্যুই জুলাই বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠে, এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ।
পরিবারের প্রতিক্রিয়া: কান্না আর কৃতজ্ঞতার মিশ্র অনুভূতি
মা মনোয়ারা বেগম বলেন,
“আমার সন্তানের রক্তের চেতনায় যদি সত্যিকারের বাংলাদেশ গড়ে ওঠে, তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব। আমি চাই, দেশে বৈষম্য না থাকুক, অন্যায়ের বিচার হোক। আমার ছেলের মতো আর কোনো তরুণ যেন গুলিতে না মরে।”
বাবা মকবুল হোসেনের কণ্ঠে ক্ষোভ ও বিচারের দাবি—
“আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে শুধু তার অধিকার চাইছিল। যে পুলিশ অফিসার তাকে গুলি করেছে, তার শাস্তি চাই। যদি বিচার না হয়, তাহলে এই জাতি ছেলের রক্তের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে না।”
স্থানীয় মানুষের অনুভূতি: গর্ব ও শোক একসাথে
বাবনপুর গ্রামের মানুষ আজ আবু সাঈদকে একজন শহীদ হিসেবেই দেখেন। প্রতিবেশী হাসান আলী বলেন,
“সাঈদ ছিল গ্রামের গর্ব। শান্ত স্বভাবের, বই পড়তে ভালোবাসতো। সে যে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে গেছে, এটা ভেবে গর্ব হয়, আবার কান্নাও আসে।”
গ্রামের ছোটরা তাকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকত, তার গল্প শুনে বড় হয়। এখন তারা নিজেরাও বলে, “সাঈদ ভাইয়ের মতো সাহসী হতে চাই।”
আন্দোলনের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া
শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগ শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং গোটা জাতির জন্য বার্তা বহন করে। তরুণ সমাজের দাবি ছিল—যোগ্যদের চাকরি, শিক্ষার সুযোগ এবং আইনের শাসন। তার মৃত্যুর পর যে আন্দোলন বিস্তৃত হয়, তা অবশেষে পরিবর্তনের সূচনা করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “শহীদ আবু সাঈদ ও তার সহযোদ্ধারা না থাকলে এই পরিবর্তন এত তাড়াতাড়ি আসতো না। তারা জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হলে জীবন দিতে হলেও দিতে হয়।”
অপেক্ষা এক নতুন দিনের
মা মনোয়ারা বেগম প্রতিদিন ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের পরিবর্তনের খোঁজ রাখেন। দেশের টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র সবই তার দেখার আগ্রহে পড়ে। তিনি অপেক্ষা করছেন—যেদিন তার চোখের সামনে সেই বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, যেখানে সাঈদের রক্ত বৃথা যাবে না।
“সেদিনই আমার সন্তানের আত্মা শান্তি পাবে। আর আমি মরেও গর্ব করব,”—এই বলেই আবার ছেলের ছবির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মনোয়ারা বেগম।
এম আর এম – ০৭০১, Signalbd.com