
মোহাম্মদপুরের মোড়ঘাটে ঘটে যাওয়া বর্বরতা; নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইনের প্রয়োজন
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় দুই বছর আগে স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার দায়ে মির্জা সাখাওয়াত হোসেন (৫১) নামের এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। সোমবার (৪ আগস্ট) এ রায় ঘোষণা করেন আদালত। এরপর অভিযুক্তকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনাচক্র ও মামলা বিবরণ
মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসায় ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে (৪৫) ১ কোটি টাকা যৌতুক দাবির জন্য স্বামী সাখাওয়াত পিটিয়ে হত্যা করেন। নিহতের বড় বোন আরজিনা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১-ক ধারায় মামলা করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন।
মামলা তদন্ত শেষে ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকার নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়। মামলায় ১৭ জন সাক্ষী উপস্থিত থেকে স্বামী-পত্নী দাম্পত্যের গোপন কষ্ট ও যৌতুক দাবির জন্য সাখাওয়াতের নিষ্ঠুরতা প্রমাণ করেন।
নির্যাতনের পেছনের সামাজিক প্রেক্ষাপট
মামলার বাদীর বক্তব্য অনুযায়ী, বিয়ের পর থেকেই সাখাওয়াত ফাতেমাকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। বিশেষত ফাতেমার বাবা-বাড়ি থেকে বিক্রি করা জমির ১ কোটি টাকা যৌতুক হিসেবে দাবি করায় তাদের মধ্যে তীব্র মনোমালিন্য চলছিল। ফাতেমা যৌতুক দিতে না পারায় স্বামীর প্রতি তার দুর্ব্যবহার বেড়েই চলছিল। এই পারিবারিক কলহের মধ্যেই ওই নির্মম ঘটনা ঘটে।
দেশে যৌতুক সমস্যা ও আইনের প্রয়োগ
বাংলাদেশে যৌতুক চাওয়া ও দেওয়ার সংস্কৃতি সমাজের বড় একটি সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। ২০১৯ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুক দাবির কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতন-হত্যার মামলা গড়ায় না বা দীর্ঘদিন বিচারস্থগিত থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আইন প্রয়োগে আরও কঠোরতা লক্ষ্য করা গেছে, যা সামাজিক সচেতনতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়িয়েছে।
নারী নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সরকার ও সমাজের সবাইকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। যৌতুকের জন্য নারীদের উপর নির্যাতন বা হত্যা যেন আর না ঘটে সেজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার ব্যবস্থা ও শাস্তির কড়াকড়ি জরুরি। বিশেষ করে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে মানসিক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে।
বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এর মন্তব্য
আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “যৌতুকের জন্য স্ত্রী নির্যাতন ও হত্যা অত্যন্ত নিন্দনীয় অপরাধ। আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে এ ধরনের কুকীর্তির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। আশা করি এ রায় থেকে অন্য কেউ অনুপ্রাণিত হবে না।”
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিসংখ্যান
- নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান: বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হন; যৌতুকের জন্য মৃত্যুর হার রয়েছে উদ্বেগজনক মাত্রায়।
- আইনি বিধান: ২০১০ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ অনুযায়ী, যৌতুক দাবির জন্য হত্যার দণ্ড সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড।
- সচেতনতা উদ্যোগ: সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠন যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে।
যৌতুক নিরোধে আমাদের করণীয়
- শিক্ষা ও সচেতনতা: পরিবার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে যৌতুকের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা এবং নারীদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করা।
- আইন প্রয়োগ: অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর বিচার নিশ্চিত করা।
- সামাজিক সমর্থন: নির্যাতিত নারীদের মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া।
মির্জা সাখাওয়াতের মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতিফলন, যা যৌতুক ও নারী নির্যাতন বন্ধে আমাদের দেশের আইনী ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে। প্রতিটি নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা অপরিহার্য। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকলকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে যাতে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয় না।
MAH – 12146 , Signalbd.com