
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম: নতুন সংকেত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে ক্রমাগত ওঠানামার মধ্যেই মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস এক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস দিয়েছে। ব্যাংকটির মতে, ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তিকে অপরিশোধিত তেলের দাম আরও কমতে পারে এবং ২০২৬ সালে তা আরও নিম্নমুখী হবে। এই তথ্য সামনে আসায় বিশ্ববাজারে এক ধরনের আশাবাদ ও সংশয়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের দাম কমানোর পূর্বাভাস
গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, ২০২৫ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের গড় দাম হবে প্রায় ব্যারেলপ্রতি ৬৪ ডলার। আগামী ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি ৫৬ ডলারে নেমে আসতে পারে। এর ফলে, জ্বালানি তেলের বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তবে তারা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কারণ যেমন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বৃদ্ধি কিংবা বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা এই পূর্বাভাসে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরানের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের সরবরাহে চাপ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে দাম বাড়ানোর সম্ভাবনাকেও উস্কে দিতে পারে।
রাশিয়া-ইরান নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ও সরবরাহ সংকট
রাশিয়া ও ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বজুড়ে তেলের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা বাড়ছে। এই সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমতে পারে, যা দাম বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, যদি সরবরাহের এই চাপ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে দাম পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, geopolitical অস্থিরতা এই বাজারের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক উত্তেজনা, যুদ্ধবিগ্রহ, এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জ্বালানি তেলের দামের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
ওপেক ও সহযোগী দেশগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা
দীর্ঘদিন ধরে তেলের দাম ধরে রাখার জন্য উৎপাদন কমিয়ে আসা ওপেক এবং তাদের সহযোগী দেশগুলো নতুন করে উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে তারা দৈনিক ৫ লাখ ৪৭ হাজার ব্যারেল তেল বেশি উত্তোলন করবে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে রাশিয়া থেকে সরবরাহ ঘাটতির আশঙ্কা, যা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সংকট এড়াতে সাহায্য করবে। সম্প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত অনলাইন বৈঠকে ওপেকের আটটি সহযোগী দেশ উত্তোলন বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেছে।
ওপেক প্লাসের পদক্ষেপ ও বাজারে প্রভাব
ওপেক প্লাসের এই উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ বাজারে দাম কমানোর সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। পিভিএম ব্রোকার ফার্মের বিশ্লেষক তামাশ ভার্গা বলেছেন, উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তেলের বাজারে চাপ সৃষ্টি করবে, যা দাম কমাতে সহায়ক হবে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, অতিরিক্ত ১৬ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল দৈনিক উৎপাদন হ্রাস প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ায় বাজারে দাম আরও কমে যেতে পারে। অর্থাৎ, বাজারে তেলের প্রাপ্যতা বাড়লে দাম স্বাভাবিকভাবেই কমবে।
সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি ও দাম
গত কয়েকদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড এবং ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম ধীরে ধীরে কমছে। আজকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৮.৬৫ ডলারে নেমে এসেছে, যা ০.১৬ শতাংশ কম। একই সময়ে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ৬৬.১৭ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা ০.১৮ শতাংশ হ্রাস।
২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে জ্বালানি তেলের দাম সামগ্রিকভাবে প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। মে মাসে ব্রেন্ট ও ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে।
জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রভাব ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনে জ্বালানি তেলের দাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে দেশের ইন্ধন ও জ্বালানি খাতেও প্রভাব পড়ে।
সরকারের পক্ষে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে এই আন্তর্জাতিক দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দাম কমে গেলে পরিবহণ, শিল্প এবং কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমবে, যা দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম কমার ফলে আমদানি ব্যয় কমে দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা পাওয়া সম্ভব হবে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তবে এই পরিস্থিতিতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। রাশিয়া ও ইরানের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞা, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, এবং বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের স্থিতিশীলতায় বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে বিশ্ব বাণিজ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তেলের মূল্যেও বড় ধরনের ওঠানামা আসতে পারে।
তাই, বাংলাদেশসহ সমস্ত জ্বালানি আমদানিকারক দেশকে এই পরিবর্তনশীল বাজার পরিস্থিতিতে সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প শক্তি উৎস অন্বেষণ করা এখন সময়ের দাবি।
মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৫ ও ২০২৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকবে। তবে geopolitical অস্থিরতা এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে দাম বৃদ্ধির ঝুঁকিও রয়েছে।
ওপেক প্লাসের উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিছুটা চাপ কমিয়ে দিতে পারে, তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব অনুভূত হবে।
অতএব, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়মিত মনিটর করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জ্বালানি খাতে উদ্ভাবনী ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে অপরিহার্য।
MAH – 12136 Signalbd.com