
যৌতুক ও নির্যাতনের শিকার স্ত্রী বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিলে, তাকে ফিরিয়ে নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন স্বামী মোজাহিদ। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে শ্বশুরবাড়ির উঠানে ও বৈদ্যুতিক মিটারে আগুন লাগিয়ে।
স্ত্রীর ‘না’—এর প্রতিশোধ নিলেন আগুন দিয়ে
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামে এক অমানবিক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন মো. মোজাহিদ (২৬) নামের এক যুবক। স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি রাতের আঁধারে শ্বশুরবাড়ির উঠানে ও বৈদ্যুতিক মিটারে আগুন ধরিয়ে দেন।
ঘটনাটি ঘটেছে রোববার (৩ আগস্ট) দিবাগত রাত ১২টার দিকে। সোমবার (৪ আগস্ট) সকালে ভুক্তভোগী পরিবার নান্দাইল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে।
ঘটনার বিস্তারিত
লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মোজাহিদ রসুলপুর গ্রামের হাদিস মিয়ার ছেলে। প্রায় চার বছর আগে তার বিয়ে হয় বালিয়াপাড়া গ্রামের কাশেম আলী ফকিরের মেয়ে সুলতানা আক্তারের (২৩) সঙ্গে।
বিয়ের এক বছরের মধ্যেই শুরু হয় পারিবারিক কলহ ও যৌতুকের চাপ। একাধিকবার অর্থ দাবি করা হয় সুলতানার পরিবারের কাছে। শুরুতে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হলেও থেমে থাকেননি মোজাহিদ। পরবর্তীতে আরও এক লাখ টাকা দাবি করলে সুলতানা রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়।
এসব নির্যাতনের কারণে সুলতানা একাধিকবার বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। প্রতিবারই মোজাহিদ ক্ষমা চেয়ে ও লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনেন। তবে নির্যাতনের ধারা বদলায়নি।
সম্প্রতি আবারও মারধরের শিকার হয়ে সুলতানা বাবার বাড়িতে চলে যান। রোববার রাতে মোজাহিদ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে আসেন, কিন্তু সুলতানা যেতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর রাতেই তিনি এই আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটান।
পুরনো কলহ ও নির্যাতনের ইতিহাস
সুলতানার ভাষ্যমতে, বিয়ের পর থেকে তার সংসার যেন ছিল এক অশান্তির নাট্যমঞ্চ। প্রতি কয়েক মাস পর পর নতুন করে টাকা দাবি করতেন মোজাহিদ। টাকা না দিলে চলতো গালিগালাজ, হুমকি ও শারীরিক নির্যাতন।
তিনি বলেন, “প্রায় এক সপ্তাহ আগে আবারও এক লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দেন। আমি রাজি না হলে মাথার চুল ধরে মারধর করেন। তখন বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসি।”
এরপর মোজাহিদ তাকে ফিরিয়ে নিতে এলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন—আরো নির্যাতনের আশঙ্কায় তিনি যেতে চান না।
আগুন ধরানোর মুহূর্ত ও প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১২টার দিকে বাড়ির আশপাশে আগুন দেখতে পান তাঁরা। দৌড়ে গিয়ে দেখতে পান, বৈদ্যুতিক মিটার থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং বাড়ির উঠানের কিছু জায়গায় আগুন ধরানো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য জানান, “ঘটনাটি শুনে আমরা দ্রুত সেখানে ছুটে যাই। আগুন ছড়াতে পারত, বড় ক্ষতি হতে পারত। মোজাহিদের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে আগে থেকেই উদ্বেগ ছিল।”
আইনগত অবস্থান ও পুলিশের বক্তব্য
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, “লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আগুন লাগানোর মাধ্যমে সম্পত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি, পরিবারকে ভয় দেখানো এবং হয়রানি করাই ছিল মোজাহিদের উদ্দেশ্য।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ ও বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন ঘটনা শুধু পারিবারিক সহিংসতার একটি নিদর্শন নয়, বরং যৌতুক ও মানসিক বিকৃতি থেকেও উদ্ভূত। সমাজে এখনও নারী নির্যাতন ও যৌতুকের দাবির মতো ঘটনা ঘটছে, যা একবিংশ শতাব্দীতেও নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে ধরছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, “এসব ঘটনার দ্রুত বিচার না হলে নির্যাতনের শিকার নারীরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।”
পরিবার ও স্থানীয়দের মন্তব্য
সুলতানার বাবা কাশেম আলী বলেন, “আমরা বারবার মেয়েকে পাঠিয়েছি, কিন্তু সে সুখে থাকেনি। আমরা চাই এখন এই ঘটনার বিচার হোক।”
স্থানীয় নারী উন্নয়ন ফোরামের নেত্রী বলেন, “সুলতানার মতো নারীরা সমাজের সবখানেই রয়ে গেছে। এদের পাশে দাঁড়াতে হবে পরিবার, প্রতিবেশী এবং রাষ্ট্রকেও।”
সারসংক্ষেপ
একজন নারী যখন নির্যাতনের মুখে নিজেকে রক্ষা করতে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন, তখন তার ‘না’ বলার স্বাধীনতাকেও প্রতিশোধের আগুনে পোড়ানো হয়—এটি সেই ঘটনার এক নির্মম চিত্র। এখন দেখার বিষয়, তদন্ত শেষে আইনি ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়।
এই ঘটনাটি শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন পারিবারিক কলহ নয়—বরং যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংসতা, এবং বিচারহীনতার বাস্তব প্রতিফলন। এর সমাধান শুধু বিচার নয়, সামাজিক সচেতনতাও জরুরি।
এম আর এম – ০৬৮৮, Signalbd.com