
গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী— এমনই অভিযোগ করেছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ২৪ জন চিকিৎসককে কোনোরকম অভিযোগ ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গাজার ২৪ চিকিৎসককে আটক ইসরায়েলের
গাজার ভেতরে চলমান সামরিক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে এবার ২৪ জন চিকিৎসককে আটক করার অভিযোগ উঠেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংগঠন ফিলিস্তিনি বন্দি সুরক্ষা কেন্দ্র জানায়, এসব চিকিৎসকদের কোনো বিচার বা অভিযোগ ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছে, এবং তাদের সঙ্গে অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে।
সংগঠনটির বিবৃতিতে জানানো হয়, গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সামরিক অভিযান চলাকালীন প্রায় ৪০০-এর বেশি চিকিৎসাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক চিকিৎসকদের অনেককে ইসরায়েলি হেফাজতে রেখে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও মানসিক অবমাননার শিকার করা হয়েছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের আটক
গাজায় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এমন দমন-পীড়নের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আগেও বেশ কয়েকবার দেখা গেছে, সংঘাতের সময় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করতে পরিকল্পিতভাবে হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, চলমান সংঘাতে গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৪০ জনেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ধ্বংস করে দিয়েছে, যার ফলে গাজায় চিকিৎসা সেবার অবস্থা ভয়াবহভাবে ভেঙে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন বলছে, চিকিৎসাকর্মীদের আটক ও নির্যাতনের মাধ্যমে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। বিশেষ করে জেনেভা কনভেনশনের ২৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যেকোনো সংঘাতে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল চিকিৎসকদের ‘টার্গেট’ করছে।
মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ ড. লিনা নাসের বলেন, “চিকিৎসাকর্মীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আটক ও নির্যাতন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।”
আন্তর্জাতিক রেড ক্রোসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলি আটক কেন্দ্রগুলোতে প্রায় ৭৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বন্দি কোনো অভিযোগ ছাড়াই ‘প্রশাসনিক আটক’-এর আওতায় রয়েছে। এটি বিচারব্যবস্থার সম্পূর্ণ বাইরের একটি পদ্ধতি, যা আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত।
ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল ও সংকটে চিকিৎসা ব্যবস্থা
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গাজার ২৩টি প্রধান হাসপাতালের মধ্যে ১৬টি ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে আহত বা অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া দিন দিন আরও দুরূহ হয়ে পড়ছে।
গাজা সিটি, খান ইউনুস, এবং রাফা অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স যারা এখনও কাজ করছেন, তারাও প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: পরিকল্পিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংসের প্রচেষ্টা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে ফেলতে চায় ইসরায়েল। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আটক করে, হাসপাতাল ধ্বংস করে, এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে একটি মানবিক বিপর্যয় তৈরি করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ইউসুফ আল খালিদ বলেন, “ইসরায়েলের এ ধরনের আচরণ কেবল একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নয়, এটি একটি সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।”
তার মতে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে গেলে তা শুধু এই অঞ্চলের জনগণের জন্যই নয়, বরং গোটা অঞ্চলের মানবিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
ভবিষ্যতের শঙ্কা ও আন্তর্জাতিক চাপ
চিকিৎসকদের আটক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংস করার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোর চাপ থাকলেও ইসরায়েল এখনও এই কার্যকলাপ বন্ধ করেনি। বরং আরও কঠোরভাবে নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি এই হামলা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকে, তাহলে গাজা অঞ্চলে একটি স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত গণবিপর্যয় ঘটতে পারে।
শেষ কথা
গাজার চিকিৎসকদের আটক ও চিকিৎসা সেবার উপর দমনপীড়ন আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মহলের এখনই উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও মানুষের প্রাথমিক অধিকার — চিকিৎসা সেবা — সুরক্ষিত থাকে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেবে তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক চাপ ও ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ০৬৮১, Signalbd.com