বিশ্ব

নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র ছাড়বে না হামাস

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিতে অস্ত্র ত্যাগের কথা ভাবছে না হামাস। গত শনিবার (২ জুলাই) নিজেদের এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা তখনই পর্যন্ত নিরস্ত্রীকরণে যেতে রাজি নয়, যতদিন না তারা পূর্ণ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার দীর্ঘ দিন ধরে চলা সংঘাতের পটভূমিতে এই ঘোষণা নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের অস্ত্র ও প্রতিরোধের অধিকার অপরিহার্য, কারণ এটি ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র হাতিয়ার। জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র ত্যাগ করবে না।

হামাসের অবস্থান: স্বাধীনতা ছাড়া অস্ত্র ত্যাগ নয়

হামাসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ইসরায়েলের অবৈধ দখল মোকাবেলায় তাদের অস্ত্রধারী প্রতিরোধ অপরিহার্য। দীর্ঘদিন ধরে গাজা ও পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চলে অব্যাহত সংঘাতের পেছনে মূলত এই অধিকার রক্ষার লড়াই রয়েছে।

তারা মনে করে, যুদ্ধবিরতির নামে তাদের নিরস্ত্রীকরণ বা অস্ত্র ত্যাগ চাওয়া অন্যায় এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আগে এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। হামাসের দাবি, তারা শুধু প্রতিরোধ করছে তাদের জন্মভূমি, তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য।

গাজায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় ইসরায়েল-হামাসের টানাপোড়েন

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রতিরোধের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলমান। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা হলেও সেগুলো কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। হামাসের নিরস্ত্রীকরণের দাবিকে ইসরায়েল এক শর্ত হিসেবে সামনে এনেছে, যা হামাস কোনভাবেই মানতে রাজি হয়নি।

গত সপ্তাহে গাজায় একটি পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টিতে হামাসের অনড় অবস্থানের কারণে আলোচনাগুলো ভেস্তে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফের গাজা সফর ও হামাসের সমালোচনা

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেন। তার এই সফরকেই হামাস সমালোচনা করেছে। হামাসের বক্তব্য, উইটকফের সফর মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর নয়, বরং একপক্ষীয় প্রভাব বিস্তার এবং ইসরায়েলের পক্ষে প্রভাবিত হওয়ার উদ্দেশ্যে।

হামাসের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রাচ্যের পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে দেখতে পারেনি, যা শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাধা সৃষ্টি করছে। গাজার জনগণের পাশে না দাঁড়ানো এবং ইসরায়েলের সমর্থন তাদের সমালোচনার মূল কারণ।

মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন সংকটের গভীরতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরোধিতা মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাধিক সঙ্কটের বিষয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তবে বৈশ্বিক রাজনীতির জটিলতায় কার্যকর সমাধান পাওয়া সম্ভব হয়নি।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বারবার যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের মূল কারণগুলো আজও অবশিষ্ট রয়েছে। এসব কারণেই ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠেনি।

ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো ইসরায়েলের কড়া প্রতিরোধ এবং বিশ্ব শক্তিগুলোর অমিশ্রিত সমর্থন। ইসরায়েল জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করায় বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়েছে। অনেক রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, বিশ্ব রাজনীতিতে তা এখনো বহুল স্বীকৃত নয়।

ফিলিস্তিনে সংঘটিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, বসতি নির্মাণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। এসবের পেছনে রয়েছে জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক কূটনীতির খেলাপথ।

হামাস ও ফিলিস্তিনি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি

হামাস শুধু একটি সশস্ত্র সংগঠন নয়, এটি ফিলিস্তিনের বহু মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিনিধিত্ব করে। গাজার বেশিরভাগ মানুষ হামাসকে তাদের প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রতীক মনে করে। যদিও আন্তর্জাতিক মহলে হামাসকে একটি উগ্র সংগঠন হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে, তবু তাদের পক্ষে অস্ত্র ত্যাগ না করার কারণ গভীর রাজনৈতিক ও মানবিক।

তারা মনে করে, স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন না হলে অস্ত্র ত্যাগ মানে তাদের অধিকার ও পরিচয়ের হারানো।


ভবিষ্যতের পথ: মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আন্তরিক সংলাপ ও বাস্তবমুখী কূটনীতি। শুধু অস্ত্র ত্যাগের দাবি দিয়ে বা একপক্ষের চাপ দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। উভয় পক্ষকে তাদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে একটি সমঝোতামূলক ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।

আন্তর্জাতিক মহলের উচিত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় অবিচ impartial, সমন্বিত ও কার্যকর ভূমিকা রাখা। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি জনগণের দীর্ঘশ্বাস ভরা স্বপ্ন পূরণের জন্য সেটাই একমাত্র উপায়।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত হামাস অস্ত্র ত্যাগ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টাগুলো শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখন একপ্রকার আটকে গেছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, আন্তরিকতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের জন্য সত্যিকারের শান্তি তখনই সম্ভব, যখন দুপক্ষ নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমঝোতায় আসবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button