কমিশনের সিদ্ধান্ত — উচ্চকক্ষে ১শ’ আসনে পিআর পদ্ধতি, বিএনপিসহ কয়েক দলের আপত্তি
বাংলাদেশের সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নতুন এক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনবিশিষ্ট এবং এসব আসন বণ্টনের জন্য সংখ্যানুপাতিক ভোট (পিআর) পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। তবে এই সিদ্ধান্তে বিএনপি এবং কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে। তাদের দাবি, উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হবে নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য এবং কমিশনের পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
উচ্চকক্ষ গঠনের প্রেক্ষাপট ও কমিশনের সিদ্ধান্ত
দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ৩১ জুলাই ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কমিশনের প্রস্তাবে উচ্চকক্ষে মোট ১০০টি আসন থাকবে এবং এসব আসন বণ্টন হবে পিআর পদ্ধতিতে, অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে দলগুলো যে শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে তাদের উচ্চকক্ষের আসন বরাদ্দ দেয়া হবে।
উচ্চকক্ষের সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন না, বরং দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে মনোনয়ন পাবে। তবে উচ্চকক্ষের নিজস্ব আইন প্রণয়ন ক্ষমতা থাকবে না। তারা শুধুমাত্র নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল পর্যালোচনা ও সুপারিশ করতে পারবে। অর্থবিল ছাড়াও সব বিল উচ্চকক্ষে উপস্থাপন করতে হবে, কিন্তু উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না।
বিএনপি ও কয়েক দলের আপত্তি
বিএনপি এবং তাদের মিত্র দলের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি এই পিআর পদ্ধতিতে আসন বণ্টনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করে, উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হবে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে, যাতে ভোটের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে দলীয় নেতারা বলেছেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের সময় ৩১ দফার প্রতিশ্রুতির অধীনে উচ্চকক্ষ হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে, যা পিআর পদ্ধতির পরিপন্থী। দলটি আগামীতেও এই অবস্থান বহাল রাখবে এবং প্রয়োজনে উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাবকেও সমর্থন করতে পারে।
অন্যান্য দলের প্রতিক্রিয়া ও মতামত
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল এই পিআর পদ্ধতিকে সমর্থন জানিয়েছে। তারা মনে করে, ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করলে পার্লামেন্টে বিভিন্ন মত ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছে। তারা বলে, বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
উচ্চকক্ষের কার্যক্রম ও ক্ষমতা
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে উভয় কক্ষে বিল উপস্থাপন করতে হবে, তবে উচ্চকক্ষ বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। যদি কোনো বিল এক মাসের বেশি সময় আটকে থাকে, তবে সেটি অনুমোদিত বলে গণ্য হবে।
যখন উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, তখন সেটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। যদি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সংশোধনের সুপারিশসহ বিলটি নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠানো হবে। নিম্নকক্ষ সেই সংশোধন গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
নারীর সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে একমত
রাজনৈতিক দলগুলো নারী সংসদ সদস্যদের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করতে একমত পোষণ করেছে। তবে নারীদের নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে পার্থক্য রয়েছে। বিএনপি সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে আসন বণ্টনের অনুপাতে নারীদের সংখ্যা বাড়াতে চায়, যেখানে অন্যান্য দল সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে।
ভবিষ্যৎ প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক উত্তেজনা
দীর্ঘ আলোচনার পরও উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কমিশন আগামী সপ্তাহে সংলাপে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, উচ্চকক্ষের গঠন এবং নির্বাচনী পদ্ধতি যদি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা সংসদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ও মতপার্থক্য এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
সারসংক্ষেপ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উচ্চকক্ষ গঠনের পরিকল্পনায় পিআর পদ্ধতি মূল ধারণা হলেও, বিএনপি ও কিছু দল এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে সংসদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কাঠামোর গঠনকে প্রভাবিত করবে।
পরবর্তী পদক্ষেপে দলগুলো কতটুকু সমঝোতায় পৌঁছায় এবং কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য, না হলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এম আর এম – ০৬২৫, Signalbd.com



