প্রযুক্তি

স্যামসাং ১৬৫০ কোটি ডলার চিপ উৎপাদন চুক্তি

Advertisement

প্রযুক্তির জগতে আবারো আলোড়ন তৈরি করল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি জায়ান্ট স্যামসাং ইলেকট্রনিকস। সম্প্রতি তারা ১৬৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি বিশাল চিপ উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা তাদের বাজার অবস্থানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি শেয়ারমূল্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই চুক্তি এমন সময়ে এসেছে, যখন এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) চিপ তৈরির প্রতিযোগিতায় স্যামসাং পিছিয়ে পড়ার ফলে আর্থিক চাপের মুখে ছিল।

স্যামসাংয়ের বিশাল চিপ চুক্তির বিস্তারিত

গত শনিবার (২৬ জুলাই) স্যামসাং একটি গোপনীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে চিপ নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মোট মূল্য দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা এক হাজার ছয়শো পঞ্চাশ কোটি ডলার। তবে, কোম্পানি এখনও চুক্তির শর্তাবলী ও প্রতিপক্ষের নাম গোপন রেখেছে এবং ২০৩৩ সাল পর্যন্ত এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রকাশের কথা বলেছে না।

স্যামসাংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটি একটি কনট্র্যাক্ট চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং চুক্তি, যেখানে তারা তাদের অত্যাধুনিক কারখানা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য চিপ তৈরি করবে।

শেয়ারবাজারে প্রভাব: ৩.৫ শতাংশ উত্থান

এই ঘোষণার পরেই সোমবার স্যামসাংয়ের শেয়ারমূল্য ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। প্রযুক্তি খাতে এমন বড় অর্ডার পাওয়া একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে জোরদার করবে।

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া স্যামসাং ও এআই চিপ নির্মাণের চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে গ্লোবাল চিপ বাজারে স্যামসাংয়ের অবস্থান টিএসএমসি (Taiwan Semiconductor Manufacturing Company) এর তুলনায় কমজোরি। বিশেষ করে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য উন্নত প্রযুক্তির চিপ তৈরিতে স্যামসাং অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। এর ফলে তাদের কিছু বড় গ্রাহক হারানোর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা।

স্যামসাংয়ের ফাউন্ড্রি বিজনেসের বড় গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে টেসলা ও কোয়ালকম। অন্যদিকে, টিএসএমসির গ্রাহক তালিকায় রয়েছেন অ্যাপল, এনভিডিয়া, এবং অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠান। ফলে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বাজারে আধিপত্য ধরে রাখার জন্য স্যামসাংয়ের জন্য এই নতুন চুক্তিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

দক্ষিণ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র চিপ খাতে নতুন অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা

চিপ শিল্পের ওপর দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান অংশীদারিত্বের প্রেক্ষাপটে এই চুক্তির গুরুত্ব দ্বিগুণ। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাতে গভীর সহযোগিতা গড়ে তুলছে। বিশেষ করে মার্কিন শুল্কের সম্ভাব্য ২৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে দক্ষিণ কোরিয়া দ্রুত কর্মসুচি নিয়েছে।

এই চুক্তি স্যামসাংয়ের টেক্সাসে নির্মাণাধীন নতুন কারখানার পরিকল্পনায় কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। টেক্সাসের কারখানার উৎপাদন শুরু বিলম্বিত হয়েছে বড় কোনো গ্রাহক না পাওয়ায়। নতুন চুক্তি সেই প্রসঙ্গে স্যামসাংয়ের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে নতুন গতি আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্যামসাংয়ের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিএনকে ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক লি মিন-হি বলেন, স্যামসাং তাদের সর্বাধুনিক ২-ন্যানোমিটার প্রযুক্তির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। তবে নতুন এই বড় অর্ডারে হয়তো এই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে না। কারণ, এই অর্ডারের চিপগুলো হয়তো কিছুটা পুরানো বা মাঝারি স্তরের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, স্যামসাং যদি টিএসএমসির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চায়, তাহলে তাদের নতুন প্রযুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বড় বড় গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী চিপ শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

বিশ্বজুড়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে চিপের চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশেষ করে এআই, স্বয়ংচালিত গাড়ি, স্মার্ট ডিভাইস ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চিপের ভূমিকা অপরিসীম। এই চাহিদার চাপ মোকাবেলায় দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ উন্নত প্রযুক্তির কারখানা নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।

স্যামসাংয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক চুক্তি জরুরি। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চিপ শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

স্যামসাংয়ের জন্য কি সূচিত করছে এই চুক্তি?

এই বিশাল চুক্তি স্যামসাংয়ের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এর মাধ্যমে তারা প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উৎপাদন ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে। শেয়ারবাজারে ইতিবাচক সাড়া আসায় বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরছে এবং দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির পথ খুলে যাচ্ছে।

তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিএসএমসি, ইনটেল ও গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজের মতো প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলা সহজ নয়। স্যামসাংয়ের সামনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির চিপ উৎপাদনে দক্ষতা অর্জনের বড় চ্যালেঞ্জ।

১৬৫০ কোটি ডলারের বিশাল চিপ চুক্তি স্যামসাংয়ের জন্য একটি শক্তিশালী যাত্রার সূচনা। এটি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতেও কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এআই এবং আধুনিক প্রযুক্তির যুগে চিপ নির্মাণে নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে তাদের আরও নতুন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।

ভবিষ্যতে স্যামসাং কিভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে গ্লোবাল মার্কেটে নিজেদের অবস্থান রক্ষা ও সম্প্রসারণ করবে, সেটাই দেখার বিষয়। প্রযুক্তি ও অর্থনীতির এই জটিল লড়াইয়ে স্যামসাংয়ের এই চুক্তি অবশ্যই একটি বড় মাইলফলক।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button