বাংলাদেশ

ঢাকার যে পাঁচ এলাকায় জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে মৃত্যু বেশি ছিল

Advertisement

জুলাই ২০২৪-এ সংঘটিত ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসে অন্যতম রক্তাক্ত অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন শত শত মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের হাতে ঘটে যায় অনেক ভয়াবহ ঘটনা। তবে রাজধানীর কিছু এলাকা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো সেই পাঁচটি এলাকা, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল।

মোহাম্মদপুর: সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির এলাকা

জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এখানে ছাত্র–জনতার শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালানোর ঘটনার ভিডিও পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়।

এই এলাকায় একদিনেই প্রাণ হারান অন্তত ৪৩ জন। আন্দোলনকারী, পথচারী, এমনকি কিছু স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীও নিহতদের তালিকায় ছিলেন। এখানে মৃতের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, কাছাকাছি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মরদেহ রাখার স্থান পর্যন্ত ফুরিয়ে গিয়েছিল।

রামপুরা: ছাত্র–জনতার তীব্র প্রতিরোধ, ভয়াবহ পরিণতি

রামপুরা এলাকায় আন্দোলনকারীরা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তবে সেই প্রতিরোধ দমনে ব্যবহৃত হয়েছিল ভারী অস্ত্র। গুলিতে নিহত হন কমপক্ষে ৩২ জন। এখানকার অনেক গলিতে সেই সময় গুলির শব্দ এবং মানুষের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল।

এই এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের একযোগে তাণ্ডব ছিল। অনেক পরিবার আজও জানে না তাদের প্রিয়জন কোথায় এবং কীভাবে মারা গেছেন।

বাড্ডা ও ভাটারা: সংগঠিত হামলা, শিকার সাধারণ মানুষ

ঢাকার পূর্বাঞ্চলের দুটি জনবহুল এলাকা— বাড্ডা ও ভাটারা— গণ–অভ্যুত্থানের সময় ভয়াবহ সহিংসতার সাক্ষী হয়ে ওঠে। এই দুই এলাকায় আন্দোলন দমনে পুলিশ ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের একযোগে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুলি ছোড়ার সময় আন্দোলনকারী ও নিরীহ পথচারীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।

এই দুই এলাকায় একত্রে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫০ জন। অনেককে ঘটনাস্থলেই মারা যেতে দেখা যায়, আবার কেউ কেউ হাসপাতালে নেবার পথে প্রাণ হারান। অনেক লাশ পরে রায়েরবাজার কবরস্থানে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন করা হয়।

নিউমার্কেট এলাকা: বিক্ষোভ দমনে ব্যাপক গুলি

নিউমার্কেট এলাকার আন্দোলন প্রথমে ছিল শান্তিপূর্ণ। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মিলে রাস্তায় অবস্থান নেয়। কিন্তু বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই শুরু হয় গুলি ও লাঠিচার্জ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিছু মানুষকে খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল।

এই এলাকায় নিহত হন ১১ জন। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। এখানে ছড়িয়ে থাকা রক্তাক্ত দৃশ্যগুলো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং দেশজুড়ে চরম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

আন্দোলনকেই দেখা হয়েছিল বিদ্রোহ হিসেবে

পুরান ঢাকার বংশাল এলাকা তীব্র আন্দোলনের মুখ দেখেছিল ১৯ জুলাইয়ের দুপুরের পরপর। এখানে শিক্ষার্থীদের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালায়। এখানেও রাজনীতিক কর্মীদের হাতে দেখা যায় আগ্নেয়াস্ত্র। অনেকে অভিযোগ করেন, আহতদের চিকিৎসা দিতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল।

এই এলাকায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এর মধ্যে কয়েকজন শিশু ও বয়স্ক মানুষও ছিলেন যারা শুধুমাত্র নিজেদের বাসায় ফেরার চেষ্টা করছিলেন। ঘটনাটি স্থানীয় মানুষের মনে গভীর ক্ষতের জন্ম দেয়।

কীভাবে গড়াল এই ভয়াবহ পরিণতি?

২০২৪ সালের ১ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে যে আন্দোলন শুরু হয়, তা প্রথমে ছিল কোটা সংস্কার ঘিরে। আন্দোলন ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ভিডিও ভাইরাল হলে ঢাকাসহ সারাদেশে উত্তাল হয়ে ওঠে জনতা।

১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত চার দিন চলা অব্যাহত গুলিবর্ষণ ও সহিংসতায় ঢাকায় পরিস্থিতি হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণহীন। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আহত ও নিহত হন। তৎকালীন সরকার ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং ‘শুট অ্যাট সাইট’ নীতির ঘোষণা দেয়।

নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শিশু ও শ্রমজীবী মানুষের আধিক্য

গণ–অভ্যুত্থানের সহিংসতায় নিহতদের একটি বড় অংশ ছিল শিক্ষার্থী ও তরুণ শ্রেণির। সরকারি গেজেট অনুসারে, নিহতদের মধ্যে ৪৫ জন ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। ১৮ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৩১ জন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।

এছাড়া বহু সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, তারাও গুলির শিকার হন। অনেকের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি, ফলে রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ।

“বর্বরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনাকে “চরম মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, এমনভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের দিয়ে আন্দোলন দমন করা হয়েছিল, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন উদাহরণ।

সারসংক্ষেপ 

জুলাই ২০২৪-এ ঢাকার পাঁচটি প্রধান এলাকায় প্রাণহানির যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে, তা কেবল একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া নয়, বরং দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নেও বড় আঘাত। নিহতদের পরিবার এখনো বিচারের আশায় অপেক্ষায় আছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে—এই রক্তপাতের দায় শেষ পর্যন্ত কে নেবে?

এম আর এম – ০৪১৩, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button