রাজশাহীর পান চাষি ও ব্যবসায়ীদের মুখে এখন একটাই কথা: পান বাজারে মূল্য সংকট! রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি বাজারে পান বিক্রির দাম এতটাই নেমে এসেছে, যে ৬৪টি পান নিয়ে একটি বিড়া (আঁটি) এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪ টাকা দরে। পান চাষীদের কাছে এ পরিস্থিতি লজ্জাজনক ও অত্যন্ত হতাশাজনক।
রাজশাহী সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পান চাষি ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে পানের একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে রাজশাহীর ‘মিষ্টি পান’ নামে খ্যাতি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে পান বাজারে দাম এতটাই কমে গেছে, যা চাষিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মোহনপুর মৌগাছি বাজারে পান বিক্রির দাম বিপর্যয়
মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি বাজারের কৃষক এনামুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার একটি বিড়া পান মাত্র ৪ টাকায় বিক্রি করেছেন। এনামুল হক বলেন, “আমার দুই বিঘা জমিতে পান চাষ করেছি। তবে এখন পান বিক্রি করে শ্রমিকের খরচও ওঠেনা। একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ তিন পোয়া (১৯২ বিড়া) পান তুলতে পারে। শ্রমিকদের খরচ ৬০০ টাকা হলেও, তিন পোয়া পান বিক্রি থেকে আমরা মাত্র ৪০০ টাকা পাই। পান থেকে এখন শুধুই ক্ষতি হচ্ছে।”
এনামুল হক আরও জানান, “মৌগাছি বাজারে বড় পানের বিড়া ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হলেও ছোট আকারের পানের দাম অনেক কম। ১৫ দিন আগেও বড় পান ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো, কিন্তু এখন সর্বোচ্চ ৩০ টাকা।”
পান চাষিদের করুণ বাস্তবতা: ক্ষতির মুখে
মোহনপুরের মদনহাটি গ্রামের পানচাষী আলতাব হোসেন বলেন, “গত বুধবার বিড়া প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা দরে পান বিক্রি করেছি। কিন্তু বৃহস্পতিবার দাম এমন কমে গেছে যে, বাজারে কেউ পান কিনছে না। ঈদের আগে খরার কারণে পানের গাছে চিনিপোকা লেগেছিল, পরে বৃষ্টি হলে পোকা চলে গিয়েছে। এখন গাছে শুধু পান আছে, কিন্তু দাম নেই।”
পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের শুভিপাড়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমানও একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, “আমার এক বিঘা জমিতে পান চাষ হয়েছে। এবারের ফলন ভালো, কিন্তু দাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বিড়া পান এখন মাত্র ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এমন দর থাকলে চাষের খরচ উঠানো কঠিন।”
বাজারে পান বিক্রেতাদের হতাশা ও বাজার অবস্থা
৩০ বছর ধরে মৌগাছি বাজারে পান ব্যবসা করা মোঃ আয়েজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, “এই পানগুলোই বাজারের সবচেয়ে ভালো। কিন্তু দাম মাত্র ৩০ থেকে ৪০ টাকা প্রতি বিড়া। ১৫ দিন আগেও এক বিড়া পান ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো। এখন দাম নিম্নমুখী।”
আরেক ব্যবসায়ী মোঃ ইসমাঈল ব্যাপারী বলেন, “গত বুধবার ১৪ টাকায় বিড়া কিনেছি, আজ দাম নেমে ৫ টাকা। তবুও পান কিনিনি কারণ ঢাকায় পাঠানো পান বিক্রি হয়নি। চাহিদা কম থাকলে কেনা অর্থহীন।”
দাম কমার কারণ ও বিশ্লেষণ
পানের দাম কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে ব্যবসায়ীরা এবং কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন:
১. সরবরাহের অতিরিক্ততা: জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পান চাষে শীর্ষ পর্যায়, তাই সরবরাহ প্রচুর।
২. দাম বৃদ্ধি ও পরিবর্তিত ভোগ: বাজারে সুপারি ও অন্যান্য পান খাওয়ার উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায়, গরিব জনগণ পান খাওয়া কমিয়েছে।
৩. আবহাওয়ার প্রভাব: খরার পরে বৃষ্টির কারণে পান গাছে রোগপোকা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়েছে।
৪. বাজারে চাহিদার স্বল্পতা: ঢাকার মতো বড় শহরে পান বিক্রির চাহিদা কমেছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরে জেলার ৯টি উপজেলায় ৪৫০৯ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯,৬৮১ মেট্রিক টন, যা গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। গত মৌসুমে ৪৫০০ হেক্টরে চাষ হয়েছিল এবং উৎপাদন ছিল ৭৭,২২০ মেট্রিক টন।
রাজশাহীর মিষ্টি পান: দেশের সেরা ও জিআই পণ্য
গত বছরের ৩১ আগস্ট ‘রাজশাহীর মিষ্টি পান’ জিআই (জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেটর) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এটি রাজশাহীর আরেকটি গর্বের বিষয়। প্রতিবছর রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পান কেনাবেচা হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতাম
উম্মে ছালমা, উপপরিচালক, রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বলেন, “জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পান উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে এ সময়ে দাম কমে যায়। তবে এবার বৃষ্টির প্রভাবে পানে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়া খাওয়ার অন্য উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় পান খাওয়ার পরিমাণ কমেছে। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দাম সবচেয়ে বেশি থাকে, তখন প্রতি বিড়া পান ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।”
তিনি আরও বলেন, “অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গড়ে প্রতি বিড়া পান ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। অতএব কৃষকরা বর্তমানে এমন ক্ষতিতে আছেন এমনটা বলা সঠিক নয়, তবে দাম কমে যাওয়ায় চাষিদের উদ্বেগ অবশ্যই আছে।”
পান চাষের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনীতিতে পান চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বিশেষ করে রাজশাহীর মিষ্টি পান দেশের বাজারে একটি অনন্য স্বাদ ও পরিচিতি লাভ করেছে।
তবে দাম সংকট ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে চাষিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে পানের গুণগত মান ও উৎপাদন বৃদ্ধি করাই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
সমাধানের কিছু প্রস্তাবনা
- সরকারি সমর্থন বৃদ্ধি: চাষিদের জন্য субসিডি বা আর্থিক সহায়তা।
- বাজার ব্যবস্থাপনা: সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীলকরণ।
- প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: আধুনিক চাষ প্রযুক্তি ও রোগ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ।
- বাজারজাতকরণ: দেশের ভিতরে ও বিদেশে ‘রাজশাহীর মিষ্টি পান’ এর ব্র্যান্ডিং ও রপ্তানি প্রসার।
রাজশাহীর পান বাজার বর্তমানে মন্দার সম্মুখীন হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য আবারও তার স্বর্ণযুগ ফিরে পেতে পারে। পানের উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকদের জীবিকা উন্নত করা সম্ভব।
এই সংকট মুহূর্তে সরকার, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগই আগামী দিনের সফলতার পথ প্রশস্ত করবে।



