অর্থনীতি

নগদে ডিজিটাল জালিয়াতি: বিশাল অংকের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ

মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’-এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া পরিবেশক এবং এজেন্ট দেখিয়ে নগদে অর্থনৈতিক জালিয়াতি ও অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক মানি বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে হিসাব মেলাতে পারছে না ২,৩৫৬ কোটি টাকা। নগদে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত পরিচালনা দল এ অনিয়মগুলো উন্মোচন করেছে।

অভিযোগের উৎস

নগদের প্রতিষ্ঠাকালে এর পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর এ অনিয়মের বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে। কর্মরত কর্মকর্তারা এই আর্থিক অনিয়মকে দেশের বৃহত্তম ‘ডিজিটাল জালিয়াতি’ বলে অভিহিত করেছেন।

অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি ও জালিয়াতি

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে জমাকৃত টাকার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করার কথা। কিন্তু প্রশাসক দল দেখতে পায়, নগদ ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি ইস্যু করেছে।

পরিবেশক ব্যবস্থার অনিয়ম

নগদ অনুমোদন ছাড়াই ৪১টি পরিবেশক অ্যাকাউন্ট খুলে, যেগুলোর মাধ্যমে ১,৭১১ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিবেশকদের কাজ ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা। নথিপত্রে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশকের ভূমিকায় অনিয়ম ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, কুমিল্লার এক পরিবেশক রংপুরের ভাতাভোগীদের অর্থ বিতরণ করেছে।

সরকারি ভাতা বিতরণে দুর্নীতি

সরকারি ভাতা বিতরণের সময়, ভাতাভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়ার পর তিন দিনের মধ্যে তা উত্তোলন না হলে নগদ নিজেই সেই অর্থ তুলে নেয়। এভাবে সরকারি ভাতার একটি বড় অংশ জালিয়াতি করা হয়েছে।

ফরেনসিক নিরীক্ষার পরিকল্পনা

বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে আর্থিক অনিয়ম তদন্তে ফরেনসিক নিরীক্ষার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই নিরীক্ষার মাধ্যমে অনিয়মের দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হবে। ইতিমধ্যে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ডাক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তালিকায় আছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক সাফায়েত আলম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা আবু রায়হান, আর্থিক প্রশাসন প্রধান রাকিবুল ইসলাম এবং সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুস সাকিব।

নগদের প্রতিষ্ঠাকালীন অনিয়ম

নগদের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালে, যখন থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি ডাক অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করে। এরপর ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ‘নগদ’ নামে সেবাটি চালু হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই এটি পরিচালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা নগদের মালিকানা ও কার্যক্রমে যুক্ত হন।

তৎকালীন নেতাদের ভূমিকা

নগদে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার ফলে অনিয়মের সুযোগ বাড়ে। থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মালিকানায় প্রথমে থাকা ব্যক্তিদের অনেকে শেয়ার ছেড়ে দিলে সেখানে আওয়ামী লীগের তৎকালীন দুই সংসদ সদস্য এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত হন।

নগদের বর্তমান অবস্থা ও করণীয়

বর্তমানে নগদ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। প্রশাসক দল নগদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

নগদ বাংলাদেশের মোবাইল আর্থিক খাতে একটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য প্রতিষ্ঠানটি আজ সংকটের মুখে। সরকারের উচিত দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা এবং গ্রাহকের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button