বাংলাদেশ

ইয়েমেনে ভারতীয় নার্স প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত!

Advertisement

ইয়েমেনে ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এমন তথ্য জানায় সরকারি সূত্রের বরাতে। এর ফলে অন্তত সাময়িকভাবে এক নারীর জীবন রক্ষা পেল, তবে পুরোপুরি মুক্তির আশায় এখনো চেয়ে আছে তার পরিবার ও ভারত সরকার।

প্রিয়া নিমিশার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত: কী জানা গেছে?

ইয়েমেনের হুতি-নিয়ন্ত্রিত রাজধানী সানার সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রয়েছেন কেরলের নার্স নিমিশা প্রিয়া। বুধবার (১৬ জুলাই) তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে ভারত সরকারের চাপ ও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েমেনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, স্থগিতাদেশ কতদিনের জন্য কার্যকর থাকবে কিংবা নতুন কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়েছে কিনা।

সূত্র জানায়, ভারত সরকার এবং প্রিয়ার পরিবার ভুক্তভোগী ইয়েমেনি নাগরিকের পরিবারের সঙ্গে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টার ফলেই মৃত্যুদণ্ড আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।

কী কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন প্রিয়া?

২০০৮ সালে নার্স হিসেবে ইয়েমেনে কাজ শুরু করেন প্রিয়া। ২০১৭ সালে এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ, ওই ব্যক্তি তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করছিলেন। সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় প্রিয়া তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে পাসপোর্ট উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগে ঐ ব্যক্তি মারা যান।

২০১৮ সালে ইয়েমেনের একটি আদালত নিমিশা প্রিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। যদিও একাধিক আপিলের পর একটি রায় বাতিল হলেও ইয়েমেনের সুপ্রিম কোর্ট বাকি দুটি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। পরে ২০২৪ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট রাশাদ আল আলিমি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেন।

ভারত সরকারের পদক্ষেপ ও আদালতের হস্তক্ষেপ

ভারত সরকার শুরু থেকেই এই মামলাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও মানবিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ইয়েমেনি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, এমনকি প্রভাবশালী হুতি নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালানো হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৪ জুলাই শুনানি করে কেন্দ্রকে জানায়, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানি আদালতকে জানান, “আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। ইয়েমেনের সঙ্গে আমাদের সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় প্রচুর বাধা আছে, কিন্তু আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।”

তিনি জানান, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ইয়েমেনি শেখের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে, তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। আদালত আগামী ১৮ জুলাই মামলাটি আবারও শুনানির জন্য নির্ধারণ করেছে।

মায়ের লড়াই ও মানবিক আবেদন

নিমিশার মা প্রেমা কুমারী মেয়েকে বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর তিনি দিল্লি হাই কোর্টে একটি আবেদনের মাধ্যমে ইয়েমেনে যাওয়ার অনুমতি চান। এরপর এপ্রিলে তিনি ইয়েমেনে যান এবং নিহত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন।

এক সাক্ষাৎকারে প্রেমা কুমারী বলেন, “গত মাসে কারাগারে আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে অনেক কষ্টে আছে, কিন্তু মনের জোর হারায়নি। আমি শুধু চাই, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হোক।”

রক্তমূল্যের বিনিময়ে মুক্তির সম্ভাবনা

ইয়েমেনের শরিয়া-ভিত্তিক আইন অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার একমাত্র বিকল্প হলো নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি। এজন্য প্রিয়ার পরিবার এবং সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল মিলে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ জোগাড় করেছে, যাতে ‘রক্তমূল্য’ হিসেবে সেটি ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে প্রদান করে ক্ষমা পাওয়া যায়।

এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়েমেনে অবস্থিত সমাজকর্মী স্যামুয়েল জেরোম ভাস্করণ, যিনি প্রিয়ার মুক্তির জন্য পরিবার এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিক দফা বৈঠক করেছেন।

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সহানুভূতির বার্তা

কেরল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এই মামলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, “এই মামলা সহানুভূতির দাবিদার। একজন ভারতীয় নার্সের জীবন বিপন্ন — মানবিক কারণে তার পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।”

অন্যদিকে, অল ইন্ডিয়া সুন্নি জামিয়াতুল উলামার সাধারণ সম্পাদক এপি আবুবকর মুসলিয়ার ইয়েমেনের এক খ্যাতনামা সুফি পণ্ডিতকে অনুরোধ করেছেন তালালের পরিবারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য, যেন তারা নিমিশাকে ক্ষমা করে দেন।

শেষ কথা

বর্তমানে নিমিশা প্রিয়া জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুদণ্ড স্থগিত হলেও চূড়ান্ত মুক্তি এখনো নিশ্চিত নয়। পুরো ভারত, বিশেষ করে কেরলবাসী তার পাশে আছে। এখন পুরো নজর ভুক্তভোগীর পরিবারের সিদ্ধান্তের দিকে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে এবং মানবিকতার জয় হয়, তবে হয়তো আবারও এক জীবন বাঁচতে পারে।

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিদেশে কর্মরত প্রতিটি বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিক কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে জীবন কাটান — এবং সেই ঝুঁকির মুহূর্তে রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজ কিভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে।

এম আর এম – ০৩৫০, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button