গত বছর যেখানে সবাই ফেল করেছিল, এবার সেই একই স্কুলে সবাই পাস করেছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক — সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। এক বছর আগের ব্যর্থতা থেকেই এসেছে আজকের এই অনন্য সাফল্য।
শিক্ষার আলোয় আলোকিত চরতেরটেকিয়া
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম চরতেরটেকিয়া। এই গ্রামের চরতেরটেকিয়া মৌজা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় একটি দুঃখজনক ইতিহাস তৈরি করেছিল — পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৯ জন শিক্ষার্থীর সবাই ফেল করেছিল। তবে সেই ব্যর্থতা যেন এক নতুন প্রত্যয় হয়ে ফিরে এসেছে। এবার, ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায়, এই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে একজন অর্জন করেছে জিপিএ ৫ — যা এই অঞ্চলে বিরল এক অর্জন।
কীভাবে সম্ভব হলো এই সাফল্য?
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, এ বছর মোট ৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ৬ জন ছিল বিজ্ঞান বিভাগের, আর ২ জন মানবিক বিভাগের। শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভাষায়, এবারের ফলাফল কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় — এটি পরিশ্রম, প্রতিজ্ঞা এবং সম্মিলিত চেষ্টার ফসল।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন,
“গতবারের ফল আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছিল। তবে সেই ব্যর্থতা থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমরা নতুন করে পরিকল্পনা করি। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন, অভিভাবকরা প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রেখেছেন, আর শিক্ষার্থীরাও নতুন উদ্যমে পড়াশোনায় মন দেয়।”
অতীতের ব্যর্থতা থেকে নতুন সূচনা
২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিদ্যালয়টির ফল ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। কেউই পাস করতে পারেনি। সেই সময় শিক্ষকদের দক্ষতা, শিক্ষার পরিবেশ, এমনকি বিদ্যালয়ের ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল এলাকাবাসীর মধ্যে। অনেকে বিদ্যালয় পরিবর্তনের চিন্তাও করেছিলেন।
তবে প্রশাসন ও শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকায় দ্রুত পরিবর্তন আসে। পাঠদান পদ্ধতিতে আনা হয় নতুনত্ব। আয়োজন করা হয় অতিরিক্ত ক্লাস, মক টেস্ট, অভিভাবক সভা এবং নিয়মিত অনুশীলনমূলক পর্যালোচনা।
প্রশাসনের তদারকি ও সহযোগিতা
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বিল্লাল হোসেন বলেন,
“গতবার ফলাফলের পর আমরা বিদ্যালয় পরিদর্শন করি এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আরও আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিই। শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে বিষয়গুলো নিয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। এই ফল তারই প্রমাণ।”
ইউএনও আরও জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকেও বিদ্যালয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও তদারকি করা হয় নিয়মিতভাবে।
এলাকাবাসীর চোখে স্বপ্নের ফলাফল
শুধু শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নয়, এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত পুরো গ্রামবাসী। অভিভাবকরা বলছেন, “আমরা ভাবতেও পারিনি এক বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন সম্ভব। এখন আমাদের মেয়েরাও পারবে দেশের মূল স্রোতে এগিয়ে যেতে।”
বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক বলেন,
“গত বছর লজ্জার মতো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার আমরা গর্বিত। শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই।”
মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের অর্জন
এই বিদ্যালয় শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য। এবং এই অর্জন প্রমাণ করেছে, সুযোগ ও সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে মেয়েরাও যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে। চরতেরটেকিয়া স্কুলের এই ফলাফল শুধু এক বিদ্যালয়ের নয় — এটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণার এক নতুন দৃষ্টান্ত।
সামনে কী পরিকল্পনা?
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা এখানেই থেমে থাকতে চান না। তাদের লক্ষ্য আগামীতে আরও ভালো ফল করা, জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানেও দক্ষ করে গড়ে তোলা।
প্রধান শিক্ষক জানান, “আমরা এবার একটা লড়াই জিতেছি। এখন বড় স্বপ্ন দেখতে চাই। আমাদের মেয়েরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যালে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতে পারে — সেটাই এখন লক্ষ্য।”
ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নেয় সাফল্য
চরতেরটেকিয়া মৌজা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এবারের সাফল্য প্রমাণ করে দিয়েছে — সঠিক দিকনির্দেশনা, আন্তরিকতা ও সহযোগিতা থাকলে কোনো চ্যালেঞ্জই অসম্ভব নয়। যারা একসময় ছিল ‘শতভাগ ফেল’ তালিকায়, আজ তারা ‘শতভাগ পাস’-এর গর্বিত অধিকারী। আর এই পরিবর্তন পুরো দেশের জন্য এক আশাবাদের বার্তা।
এম আর এম – ০২৮৫, Signalbd.com



