বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস একটি অতি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অনেকে হয়তো জানেন না, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শুরু হবার আগেই শরীরে এক ধরণের পরিবর্তন দেখা দেয়, যাকে বলা হয় প্রি-ডায়াবেটিস। সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে এটি দ্রুত টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে। তবে সঠিক জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে প্রি-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং এটি থেকে পুরোপুরি মুক্তিও পাওয়া যায়।
প্রি-ডায়াবেটিস কী?
প্রি-ডায়াবেটিস মানে হলো আপনার রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, কিন্তু ডায়াবেটিস হওয়ার পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি। এ অবস্থাকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পূর্ববর্তী ধাপ বলা হয়। এটি একটি সতর্কবার্তা—আপনার শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে যা ভবিষ্যতে বড় রোগে রূপ নিতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন আপনি প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?
প্রি-ডায়াবেটিসে সাধারণত কোনো স্পষ্ট উপসর্গ দেখা যায় না। অনেকেই রুটিন চেকআপ না করলে তা জানতে পারেন না। তবে কিছু সাধারণ ইঙ্গিতের মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত ওজন (বিশেষ করে পেটের চারপাশে চর্বি)
- উচ্চ রক্তচাপ
- পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস
- কম শারীরিক পরিশ্রম
- অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৪৫ বছরের বেশি বয়সী, স্থূল বা পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে বছরে একবার ব্লাড সুগার পরীক্ষা করানো উচিত।
প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কীভাবে বাড়ে?
প্রি-ডায়াবেটিসের মূল কারণ হলো শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। ইনসুলিন শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি হরমোন যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যদি শরীর ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে।
অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত বা সুগারযুক্ত খাবার খাওয়া, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
প্রি-ডায়াবেটিস প্রতিরোধে যা করবেন
১. ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন
আপনার শরীরের বর্তমান ওজনের মাত্র ৫–১০ শতাংশ কমিয়ে ফেললেও প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। বিশেষ করে পেটের মেদ কমানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ এটি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের মূল উৎস।
২. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেমন:
- উচ্চ ফাইবারযুক্ত শাকসবজি খান (পালং শাক, ঢেঁড়স, ব্রোকলি)
- গোটা শস্য বেছে নিন (লাল চাল, ওটস, ব্রাউন ব্রেড)
- প্রোটিন গ্রহণ বাড়ান (ডিম, মটরশুটি, কম চর্বিযুক্ত দুধ ও দই)
- ফলমূল খান, বিশেষ করে আপেল, ব্লুবেরি, আঙ্গুর
- প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন
৩. নিয়মিত শরীরচর্চা করুন
সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (যেমন brisk walking, সাইক্লিং বা সাঁতার) করলে শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। অফিসে বা ঘরে দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে মাঝেমধ্যে উঠে হাঁটাহাঁটি করা অভ্যাস করুন।
৪. ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম না হলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে পারে। পাশাপাশি অতিরিক্ত মানসিক চাপ ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এসব মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি
প্রি-ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নিম্নোক্ত খাবার ও পানীয়গুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন:
- সোডা, কোমল পানীয়, ফ্লেভারড দুধ
- প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ, সালামি)
- ময়দা দিয়ে তৈরি খাবার (পেস্ট্রি, বিস্কুট, পরোটা)
- ফাস্ট ফুড (বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই)
- হোয়াইট ব্রেড ও হোয়াইট রাইস
প্রি-ডায়াবেটিস নিরাময় সম্ভব?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক পদক্ষেপ নিলে প্রি-ডায়াবেটিস রিভার্স করা সম্ভব। নিয়মিত চেকআপ, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে আপনি টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে নিজেকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারেন।
ডা. রয় টেইলর নামক ব্রিটিশ গবেষকের মতে, শরীরের মোট ওজনের মাত্র ১০% কমিয়ে ফেলা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করলে অনেক ক্ষেত্রেই টাইপ-২ ডায়াবেটিস পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায়।
আতঙ্ক নয়, সচেতনতা জরুরি
প্রি-ডায়াবেটিস মানেই ডায়াবেটিস হবে—এমনটা ভাবার কিছু নেই। বরং এটি একটি সুযোগ—নিজেকে সতর্ক করার, সুস্থ জীবন গড়ার এবং ভবিষ্যতের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার।
আপনার জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তন এনে আজ থেকেই শুরু করুন স্বাস্থ্য সচেতন পথচলা। মনে রাখবেন, সচেতনতাই সুস্থতার প্রথম ধাপ।
এম আর এম – ০২৬১, Signalbd.com



