বিশ্ব

ইসরায়েলের সমালোচনা করায় জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

Advertisement

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ ফ্রানচেসকা আলবানিজের ওপর প্রতিবন্ধকতা

জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ তুলে একটি সংবেদনশীল প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেই প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, আলবানিজ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ চালাচ্ছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই অভিযোগকে ভিত্তি করে আলবানিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপন

ফ্রানচেসকা আলবানিজ জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তাঁর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রতিবেদনে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়েছে যারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে।

আলবানিজ বলছেন, এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক অপরাধ ও গণহত্যার শামিল। গাজায় প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি এবং ওষুধ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণকে জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ভূমিকা ও ইউরোপীয় সমর্থন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত কয়েক মাসে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

তবে আইসিসির এই পদক্ষেপের পরও ইউরোপের কিছু দেশ, যেমন ইতালি, ফ্রান্স ও গ্রিস, তাদের আকাশসীমা ব্যবহারের মাধ্যমে নেতানিয়াহুকে সহায়তা করে যাচ্ছে, যা আলবানিজের মতে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, আলবানিজের প্রতিবেদনগুলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণ। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, আলবানিজ আইসিসিকে ব্যবহার করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন, যা ইহুদিবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে, যা আইসিসির বিরুদ্ধে কাজ করা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রাখে। এর আওতায় আলবানিজ ছাড়াও আইসিসির চার বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর শীর্ষকর্মীরা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কড়া সমালোচনা করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, বিশেষ প্রতিবেদনকারীরা সরকারের প্রতি নয়, বরং মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ। আলবানিজ তার দায়িত্ব পালন করছেন নিরপেক্ষ ও সৎভাবে এবং তাঁর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার ও বিশেষজ্ঞ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি বড় আঘাত।

ফ্রানচেসকা আলবানিজের বক্তব্য

আলবানিজ নিজে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মাফিয়া স্টাইলে ভয়ভীতি প্রদর্শন আমার কোনো বিষয় নয়। আমি এখন সদস্য রাষ্ট্রদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি তাদের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষা ও গণহত্যার সংগঠকদের শাস্তি দেওয়ার।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলবানিজ লিখেছেন, ‘যে সমস্ত রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, তারা নিজেদেরই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমরা সবাই এই ঝুঁকির অংশ। আমাদের দায়িত্ব সুস্পষ্ট — মানবাধিকার রক্ষা করা।’

গাজায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়

গাজায় প্রায় ২১ মাস ধরে চলমান ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সামরিক অভিযানে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, অন্তত ৫৭ হাজার ৫৭৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পানি সরবরাহ সীমাবদ্ধ হওয়ায় মানবিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

এই সংকটের মাঝে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে, তবে নিরাপত্তাজনিত ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কারণ। বিশ্বে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এই সংঘাত ক্রমাগত জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান ও পদক্ষেপ এই সংঘাতের গতি ও দিশা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখন প্রয়োজন সংযম, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য কঠোর উদ্যোগ নেওয়া।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষায় বাধা স্বরূপ। এটি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে মানবাধিকার রক্ষার জন্য দায়িত্বশীলতার পুনঃস্মরণ করিয়ে দেয়। গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চেতনা ও চাপ বৃদ্ধি পেলে সেখানকার জনজীবন আরও নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের রক্ষাকারীদের প্রতি সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাই শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান শর্ত।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button