বিশ্ব রেকর্ডের মাত্র ৩৩ রান দূরে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক উইয়ান মুলডার। লারার ৪০০ রানের কীর্তি ভাঙার সুযোগ ছিল সামনে, কিন্তু ইতিহাসের সেই পাতায় নিজের নাম লেখানো থেকে নিজেই সরে এলেন তিনি—শুধুমাত্র কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার প্রতি সম্মান জানিয়ে।
৩৬৭ রানে থেমে যাওয়া এক মহাকাব্যিক ইনিংস
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়ে টেস্টে ব্যাট হাতে ঝড় তোলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক উইয়ান মুলডার। প্রথম ইনিংসে তিনি খেলেন ৩৬৭ রানের এক অতিমানবীয় ইনিংস। মাত্র ৩৩ রান বাকি ছিল ব্রায়ান লারার ২০০৪ সালের গড়া ৪০০ রানের রেকর্ড স্পর্শ করতে। তবে ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে, দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চের পরই ইনিংস ঘোষণা করেন মুলডার, যা বিশ্ব ক্রিকেটে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অতীত রেকর্ড ও মাইলফলক: ইতিহাসে নাম লেখানো
এই ইনিংসের মধ্য দিয়ে একাধিক রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন মুলডার। হাশিম আমলার ৩১১ রানের রেকর্ড ভেঙে তিনিই এখন দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের মালিক। শুধু তাই নয়, মাত্র ২৯৭ বলে ত্রিশতকে পৌঁছে গিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিতীয় দ্রুততম ট্রিপল সেঞ্চুরিকারী হিসেবে নাম লেখান। এর চেয়ে দ্রুত ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন কেবল বীরেন্দ্র শেবাগ (২৭৮ বল)।
বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বড় ইনিংসের তালিকাতেও শীর্ষে উঠে এসেছেন মুলডার। ১৯৫৮ সালে হানিফ মোহাম্মদের ৩৩৭ রানের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। সেইসাথে সনাৎ জয়সুরিয়া (৩৪০), লেন হাটন (৩৬৪), গ্যারি সোবার্স (৩৬৫) – এসব কিংবদন্তিদেরও পেছনে ফেলেছেন।
লারার প্রতি শ্রদ্ধা
মুলডারের ইনিংস ছিল নিরবিচারে চালিয়ে যাওয়ার মতই। মাঠে থাকাকালীন সবাই ভাবছিলেন, এই ম্যাচেই হয়তো দেখা যাবে নতুন এক ইতিহাস। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রোটিয়া ড্রেসিংরুম থেকে সিদ্ধান্ত এলো—ইনিংস ঘোষণা। মূলত মুলডার নিজেই এই সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তিনি মনে করেন, ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ডকে ছুঁয়ে ফেলাটা কৃতিত্ব হলেও, সেটিকে অতিক্রম করাটা কিংবদন্তিকে অসম্মান করা হতে পারে।
এই কীর্তি তাই ক্রিকেটবিশ্বে দেখা হয়েছে এক দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত হিসেবে—যেখানে ব্যক্তিগত কীর্তির চেয়ে বড় হয়েছে সম্মান।
অন্যান্য ব্যাটারদের পারফরম্যান্স
মুলডারের রানের ঝড়ের পাশাপাশি বাকিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। চারে নামা বেডিংহাম ৮২ রান করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রিটোরিয়াস যোগ করেন আরও ৭৮ রান। উইকেটরক্ষক কাইল ভেরায়েন অপরাজিত থাকেন ৪২ রানে। ডেওয়াল্ড ব্রেভিস করেন ৩০ রান। দলীয় স্কোর দাঁড়ায় ৬২৫/৫ – যা ইনিংস ঘোষণার জন্য যথেষ্ট মনে করেছেন অধিনায়ক মুলডার।
সমালোচনা নাকি প্রশংসা?
মুলডারের এই সিদ্ধান্তে ক্রিকেটবিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে মনে করছেন, এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না—তাই রেকর্ডটা নেওয়াই উচিত ছিল। অন্যদিকে অনেকেই এই কীর্তিকে দেখছেন চরিত্রের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিংবদন্তিদের প্রতি এমন শ্রদ্ধা দেখানো যে কেবল স্কোরবোর্ডে নয়, হৃদয়ে জায়গা করে নেয়—মুলডার তা প্রমাণ করেছেন।
পরিসংখ্যান ও তুলনা: ইতিহাসের সেরা ইনিংসের তালিকায় মুলডার
মুলডারের ৩৬৭ রানের ইনিংস এখন টেস্ট ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর। তার ওপরে আছেন:
- ব্রায়ান লারা (৪০০*)
- ম্যাথু হেইডেন (৩৮০)
- ব্রায়ান লারা (৩৭৫)
- মাহেলা জয়াবর্ধনে (৩৭৪)
মুলডার এদের সবাইকে ছুঁয়ে ফেলতে পারতেন। তবু, এই জায়গা থেকেই তিনি স্বেচ্ছায় সরে এসে নিজের মানবিকতা ও ক্রীড়াসংস্কৃতির উদাহরণ গড়ে তুললেন।
“আমি শুধু রেকর্ড গড়তেই খেলি না, ক্রিকেট আমার জন্য সম্মানের খেলা। লারার সেই ইনিংস ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়, আমি সেটিকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম—অতিক্রম নয়।”
— উইয়ান মুলডার, দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক
কী হতে পারতো আর কী হলো
ইতিহাসের দরজায় পৌঁছে ফিরে আসা খুব কম খেলোয়াড়ের ভাগ্যে জোটে। উইয়ান মুলডার সেই বিরল উদাহরণ। একদিকে অনন্য ইনিংস, অন্যদিকে কিংবদন্তির প্রতি অনবদ্য শ্রদ্ধা—এই দুইয়ের মিলনেই সৃষ্টি হলো ক্রিকেটের এক অসাধারণ অধ্যায়।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—যদি তিনি চালিয়ে যেতেন, তবে কি সত্যিই লারার ৪০০ রানের অটল রেকর্ড ভেঙে যেত?
এম আর এম – ০২১৬, Signalbd.com



