
ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপে বিশ্ববাজারে ধস নামছে ডলারের
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মার্কিন ডলারের যে দরপতন দেখা গেছে, তা গত পাঁচ দশকে নজিরবিহীন। ইউরো, পাউন্ড, ইয়েনসহ বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ডলারের মান কমেছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পতনের মূল পেছনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নমুখী বাণিজ্যনীতি, আত্মকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি এবং ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ।
ডলারের পতনের কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কৌশলের নাটকীয় পরিবর্তন এর পেছনে অন্যতম কারণ। ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী শুল্কনীতি, “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে আসার প্রবণতা বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
এই নীতিগুলোর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের প্রতি আস্থা কমে যায়। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি ও সরকারিভাবে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বিনিয়োগকারীদের আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
১৯৭৩ সালেও ডলারের দাম বড় ধরনের পতনের শিকার হয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র সোনার মান (Gold Standard) থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ।
সেই সময়ের পর থেকে ডলার একাধিক ধাক্কা সামলে উঠলেও, এবারের পতন আরও গভীর ও বহুমাত্রিক। কারণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তই নয়, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক জটিলতাও এর সঙ্গে জড়িত।
কে কী বলছেন?
স্টিভ ইংল্যান্ডার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বৈদেশিক মুদ্রা বিশ্লেষক, বলেন:
“ডলার দুর্বল না শক্তিশালী—এটা বড় প্রশ্ন নয়। আসল প্রশ্ন হলো, বিশ্ব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কীভাবে দেখা হচ্ছে।”
এই মন্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় যে, বর্তমান সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি রাজনৈতিক আস্থা সংকটও বটে।
পতনের প্রভাব কোথায় পড়ছে?
১. বিদেশ ভ্রমণে খরচ বেড়েছে মার্কিন নাগরিকদের জন্য।
২. যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, যেটি মার্কিন অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা।
৩. রপ্তানিকারকদের জন্য সাময়িক সুবিধা হলেও, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেটে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে।
বিনিয়োগকারীদের নতুন খোঁজ: বিকল্প মুদ্রা ও দেশ
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে ডলার নির্ভরতা থেকে সরে আসছেন। অনেক পেনশন তহবিল, বীমা কোম্পানি ও ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান এখন ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের শেয়ারবাজার ও সম্পদের দিকে ঝুঁকছে। কারণ, এসব অঞ্চলে ডলারের চেয়ে ভালো রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে।
একই সময়, ইউরোস্টক্স ৬০০ সূচক যখন ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই একই রিটার্ন ডলারে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় প্রায় ২৩%। এর বিপরীতে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর ২৪% মুনাফাও ইউরোতে হিসাব করলে মাত্র ১৫%।
একটি বড় সতর্কবার্তা?
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দেয়, যার মধ্যে ছিল ডলারে লেনদেন বন্ধ এবং রাশিয়ার বৈদেশিক সম্পদ জব্দ। এর পর থেকেই অনেক দেশ ডিডলারাইজেশন নীতি গ্রহণ করে—অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রা ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয়।
চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নিজস্ব বা বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করছে। এটি ডলারের ওপর দীর্ঘমেয়াদি আস্থার সংকেত দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল খরচ কমানো। নতুন বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, এক দশকে ঘাটতির পরিমাণ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যখন ঋণ বাড়ছে, তখনই যদি বিনিয়োগকারীরা মার্কিন সম্পদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে সেই ঋণ পূরণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতে করে ট্রেজারি বন্ড আর ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে কাজ করবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
ভবিষ্যতে কী হবে?
বর্তমানে যেভাবে ডলারের মূল্যপতন ঘটছে, তা স্বল্পমেয়াদে মার্কিন রপ্তানিকারকদের জন্য সুবিধাজনক হলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য গুরুতর সংকট ডেকে আনতে পারে। মূল্যস্ফীতি, ঋণ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—এই ত্রিমুখী চাপে বিশ্ব অর্থনীতির পুরোনো ‘নির্ভরযোগ্য বন্ধু’ ডলার আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
এক নতুন বৈশ্বিক অর্থনীতির ইঙ্গিত?
ডলারের বর্তমান পতন শুধু একটি মুদ্রার দামের পতন নয়—এটি বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে ডলার তার আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে তো? নাকি বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে এক বহুমুদ্রা নির্ভর অর্থনীতির দিকে?
এম আর এম – ০১৩৫, Signalbd.com