Uncategorized

শাটডাউন কর্মসূচির প্রভাব আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অচলাবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাস্টমস ও স্থলবন্দরগুলোতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রথম দিনেই ব্যাপক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এ কর্মসূচির কারণে আজ শনিবার সকাল থেকে বন্ধ হয়ে পড়েছে কাস্টমস সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কার্যক্রম। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, থেমে গেছে কাঁচামাল সরবরাহ, আটকে পড়েছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক।

চট্টগ্রাম বন্দরে জট, থেমে যাচ্ছে গতি

শনিবার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ নম্বর গেট এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ জট দেখা গেছে। বন্দর চত্বরে যানজট তৈরি হওয়ায় স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে এই পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতিতে শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানির জন্য জেটিতে ভেড়ানো নতুন কোনো জাহাজে কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, “পুরোনো অনুমোদন থাকা জাহাজগুলো থেকে কনটেইনার ওঠানামা চলছে। কিন্তু নতুন রপ্তানির জন্য পণ্য ছাড় হচ্ছে না, ফলে পুরো রপ্তানি কার্যক্রম ঝুঁকিতে।”

শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে পুরো বন্দরের কার্যক্রম অচল হয়ে পড়বে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর প্রভাব পড়বে শিল্প-কারখানায়।”

ঢাকায় এনবিআর ভবন কার্যত অবরুদ্ধ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রধান কার্যালয়েও দেখা গেছে অচলাবস্থা। সকাল ছয়টা থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচির পর কেউ অফিসে প্রবেশ করতে পারেননি। ভিতরে থাকা কর্মকর্তাদেরও বের হতে দেওয়া হয়নি। ফলে এনবিআরের সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কর্মসূচির আয়োজকরা দাবি করছেন, এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, চেয়ারম্যানের অপসারণ এবং কাঠামোগত সংস্কারের দাবিতে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

বেনাপোলে থেমে গেছে আমদানি-রপ্তানি

যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরেও একই চিত্র। সকাল থেকে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিজ কার্যালয়ে বসেননি। এতে ১০০টি রপ্তানি ট্রাক ও ৪০০টি আমদানিকৃত ট্রাক দিনের শুরু থেকেই সীমান্তে আটকা পড়ে।

বন্দর ব্যবহারকারী মতিয়ার রহমান জানান, “আমরা অন্তত ১০০ ট্রাক রপ্তানি করতে পারিনি, ৪০০ ট্রাক দেশে ঢুকেছে ঠিকই, কিন্তু খালাস হয়নি। কাঁচামাল না পেলে শিল্প থেমে যাবে।”

সোনামসজিদে আটকা রপ্তানি পণ্য

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকেও এসেছে একই ধরনের খবর। দুপুর পর্যন্ত কোনো আমদানি পণ্য প্রবেশ করেনি এবং রপ্তানিও হয়নি। বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা ও বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড নিশ্চিত করেছে, কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

সোনামসজিদ কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা কেন্দ্রের নির্দেশে পুরোপুরি কর্মবিরতিতে আছি। সন্ধ্যায় পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম চলবে না।”

বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মাঈনুল ইসলাম জানান, “ভারতের মহদিপুর বন্দরে কয়েকশ ট্রাক বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে। এটি শুধু বন্দরের নয়, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্যও বিরাট ক্ষতি।”

আখাউড়া স্থলবন্দরে সীমিত কার্যক্রম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে আজ শনিবার সীমিত পরিসরে ২৬টি পণ্যবাহী গাড়ি আগরতলায় রপ্তানি করা গেছে, কারণ এসব পণ্যের আগাম অনুমোদন ছিল। তবে নতুন কোনো পণ্যের রপ্তানি হয়নি।

আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, “আগে অনুমোদন পাওয়া ৩০ টন আটা ও ১১৫ টন মাছ আজ রপ্তানি হয়েছে। এরপর আর কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী নেসার আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, “বন্দরে কার্যত কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। আমরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি।”

রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমরা সবাই অফিসে আছি, কিন্তু কাজ করছি না। নতুন করে কোনো পণ্যের কাগজ জমা পড়েনি।”

বাংলাবান্ধায় জমেছে ১৪৮ ট্রাক পাথর

পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরেও শুল্কায়ন কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ। ভুটান থেকে আমদানি করা পাথরবাহী ১৪৮টি ট্রাক বন্দরে পৌঁছালেও শুল্ক আদায় বা খালাস হয়নি।

সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “শুল্কায়ন না হলে ট্রাকের খালাস হবে না। এতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট—দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

বাংলাবান্ধা বন্দর ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ বলেন, “আজ সাধারণত কম পণ্য রপ্তানি হয়। বিকেল পর্যন্ত কোনো রপ্তানি পণ্যবাহী গাড়ি বন্দরে আসেনি।”

‘মার্চ টু এনবিআর’ এবং বৃহত্তর দাবি

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ আজ ঢাকায় এনবিআর সদর দপ্তরে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করেছে। তারা দাবি করছেন, এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নীতির অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংগঠনটির আহ্বায়ক বলেন, “আমাদের দাবি স্পষ্ট—চেয়ারম্যানের অপসারণ, পদোন্নতি নীতিতে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সংস্কার চাই।”

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই কর্মসূচি দীর্ঘায়িত হয়, তবে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে। পণ্য খালাসে দেরি হলে সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে, কাঁচামাল না পেলে বন্ধ হয়ে যাবে উৎপাদন। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে নতুন করে জনজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি—তড়িঘড়ি করে কাস্টমস কার্যক্রম চালু করতে হবে, না হলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।”

উপসংহার

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রভাব শুধু কাস্টমস বা রাজস্ব খাতে সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে শিল্প, বাণিজ্য, রপ্তানি ও আমদানির প্রতিটি শাখায়। এখন প্রয়োজন দ্রুত, কার্যকর এবং টেকসই সমাধান। তা না হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহে এই শাটডাউন পরিণত হতে পারে এক গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button