সাইপ্রাসে বিপুল জমি কিনছে ইসরায়েলিরা, দেশ বেদখলের শঙ্কা রাজনীতিবিদদের

ইসরায়েলি বিনিয়োগে বদলে যাচ্ছে সাইপ্রাসের ভূপ্রকৃতি, উদ্বেগে স্থানীয় রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ
সম্প্রতি সাইপ্রাসে ব্যাপক হারে জমি ও রিয়েল এস্টেট কিনছেন ইসরায়েলের নাগরিকরা। রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে এতে দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ। স্থানীয় নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে একসময় নিজেদের মাটিতেই পরবাসী হয়ে পড়বে সাইপ্রাসবাসী।
ইসরায়েলিদের ক্রমবর্ধমান জমি ক্রয়: কী ঘটছে সাইপ্রাসে?
সাইপ্রাসের প্রধান শহরগুলো—বিশেষ করে লিমাসোল ও লারনাকা—জুড়ে দ্রুতগতিতে সম্পত্তি কিনছেন ইসরায়েলি নাগরিকরা। বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, এমনকি বড় বড় বাণিজ্যিক প্লট পর্যন্ত কিনে নিচ্ছেন তারা। এ চিত্র এখন এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে, লিমাসোলের একাধিক এলাকায় ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে ‘গেটেড কমিউনিটি’, যেখানে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র ইসরায়েলিদের জন্য সংরক্ষিত।
আকেল নামে স্থানীয় একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল এ নিয়ে মুখ খুলেছে। দলের মহাসচিব স্তেফানো সতর্ক করে দিয়েছেন—“যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, একদিন আমরা নিজেদের দেশেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ব।”
কেন সাইপ্রাসে আশ্রয় নিচ্ছে ইসরায়েলিরা?
বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং সেই সূত্রে ইসরায়েলে যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায়, অনেক ইসরায়েলি তাদের দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রয়েছে। সাইপ্রাস—একটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দ্বীপরাষ্ট্র—তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক বিকল্প হয়ে উঠেছে।
সূত্র বলছে, ইরানের পাল্টা হামলার পর প্রায় ১২,০০০ ইসরায়েলি সাইপ্রাসে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের অনেকেই এখন স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
রাজনৈতিক উদ্বেগ ও নিরাপত্তা শঙ্কা
সাইপ্রাসে ইসরায়েলিদের ভূমি ক্রয়ের প্রবণতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা শরণার্থী ইস্যু হিসেবে না দেখে, রাজনৈতিক দল আকেল এটিকে একটি ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখছে। তাদের আশঙ্কা, ইসরায়েল একটি ছদ্ম-বাসস্থান গড়ে তুলছে, যা ভবিষ্যতে দেশটির স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
স্তেফানো বলেন, “আমরা লিমাসোল ও লারনাকায় এমন কিছু এলাকায় গেটেড কমিউনিটি, জায়নবাদী স্কুল এবং সিনাগগ নির্মিত হতে দেখছি—যেখানে ইসরায়েলি নাগরিক ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই।”
সংবেদনশীল স্থানে জমি ক্রয়: নিরাপত্তার ইঙ্গিত?
এ বিষয়ে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো—ইসরায়েলিরা এমনসব স্থানে জমি কিনছে, যা সাইপ্রাসের জাতীয় নিরাপত্তা স্থাপনাগুলোর আশপাশে। একাধিক রাজনীতিবিদ এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সাইপ্রাসের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর স্থাপনাগুলোর আশেপাশে এভাবে জমি ক্রয় নিরাপত্তাজনিত হুমকির ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যানে ইসরায়েলি প্রভাব
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে শুধু লারনাকাতেই ইসরায়েলিরা কিনেছে ১৪০৬টি সম্পত্তি। এর মধ্যে ৪৮১টি সম্পত্তির মালিকানার দলিল ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছে তারা।
একই সময়ে লিমাসোলে তারা কিনেছে ১১৫৪টি সম্পত্তি, যার মধ্যে ৫১১টি সম্পূর্ণভাবে রেজিস্টার করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা কিনেছে ২৭৪৩টি এবং রুশ নাগরিকেরা ২৫৬১টি সম্পত্তি—তবে ইসরায়েলিদের ক্ষেত্রেই রাজনীতিক ও জনসাধারণের উদ্বেগ বেশি।
‘গোল্ডেন ভিসা’ ও নতুন আইন প্রস্তাব
ইসরায়েলিসহ তৃতীয় দেশের (অ-ইইউ) নাগরিকদের জমি ক্রয়ে সুবিধা করে দিয়েছে ‘গোল্ডেন ভিসা’ নামের একটি প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে অন্তত ৩ লাখ ইউরোর বিনিয়োগে সাইপ্রাসে বসবাস ও নাগরিকত্বের সুযোগ পাওয়া যায়।
এ সুযোগের অপব্যবহার রোধে আকেল দল দুইটি বিল উত্থাপন করেছে। প্রস্তাবিত আইনে এই ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ এবং বিকল্প মালিকানা প্রক্রিয়াগুলো তদন্তের কথা বলা হয়েছে।
“সাইপ্রাস একটি ছোট দেশ, এবং এটি এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে অস্থিরতা স্বাভাবিক। তাই আমাদের আরও সচেতন ও আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে।” — স্তেফানো, আকেল দলের মহাসচিব
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এখন নিজের জন্য একটি ‘বিকল্প আশ্রয়’ তৈরি করতে চাইছে, যেন ভবিষ্যতে যেকোনো সামরিক বা রাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে তাদের নাগরিকদের নিরাপদে রাখা যায়। আর সাইপ্রাস, যার ইতিহাসে ইহুদিদের জন্য সহানুভূতির ছাপ রয়েছে, সেই জায়গায় তারা স্থায়ী ভিত্তি গড়তে চাইছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে—এটা কি নিছক নিরাপত্তার জন্য, নাকি ভবিষ্যতের বিস্তৃত কৌশলের অংশ? স্থানীয় জনগণ এখনই এসব বিষয়ে প্রতিবাদ না জানালে, হয়তো একদিন তাদের ইতিহাসই পাল্টে যাবে।
সারসংক্ষেপ
ইসরায়েলিদের সাইপ্রাসে জমি কেনার এই প্রবণতা এখন আর নিছক রিয়েল এস্টেট ব্যবসা নয়—এটি হয়ে উঠেছে একটি কৌশলগত সংকেত। সাইপ্রাসের রাজনীতিবিদদের এখনই শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার, নাহলে ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের ভূমি নিজেদের হাতেই থাকবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এম আর এম – ০০৭৮, Signalbd.com