৫০ কেজির বাগাড় মাছ পদ্মা নদীতে, বিক্রি ৭৭ হাজার টাকায়

রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে জেলের জালে ধরা পড়ল বিরল ও মহাবিপন্ন প্রজাতির বাগাড় মাছ, যার ওজন প্রায় ৫০ কেজি। আজ শনিবার (২৮ জুন ২০২৫) দুপুরে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের কলাবাগান এলাকায় এই বিরল মাছটি জেলে সিদ্দিক হলদারের জালে ধরা পড়ে। মাছটি বিক্রি হয়েছে ৭৭ হাজার ৫০০ টাকায়।
পদ্মা নদীর বিশাল বাগাড় মাছের সন্ধান
জেলে সিদ্দিক হলদার জানান, দুপুরে পদ্মার বিভিন্ন স্থানে মাছ শিকারের জন্য জাল ফেললেও প্রথমে কোনো বড় মাছ ধরা পড়ে না। কিন্তু কলাবাগান এলাকায় যখন জাল ফেলা হয়, তখন বিশাল আকৃতির এই বাগাড় মাছ জালে আটকা পড়ে। স্থানীয়রা মাছটি দেখতে ভিড় করেন, এবং ওজন করা হয় ৫০ কেজি।
আড়তদার রেজাউল মণ্ডল বলেন, “মাছটি আমার আড়তে নিয়ে আসা হয়, কেজিপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ টাকা। মাছ ব্যবসায়ী চান্দু মোল্লা এই মাছটি নিলামে ক্রয় করেন।”
বিক্রির পেছনের পরিকল্পনা ও লাভের হিসাব
স্থানীয় ব্যবসায়ী চান্দু মোল্লা বলেন, “এত বড় বাগাড় মাছ খুব কম দেখা যায়। আমি মাছটি কিনে ফেরি ঘাটের পন্টুনে বেঁধে রেখেছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে বিক্রির চেষ্টা করছি। কেজিপ্রতি মাত্র ১০০ টাকা লাভ হলেও বিক্রি করব।”
বাগাড় মাছ: সংরক্ষিত ও বিরল প্রজাতি
বাগাড় মাছ বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-এর ২ নম্বর তফসিলভুক্ত। এটি একটি মহাবিপন্ন ও সংরক্ষিত প্রজাতি, যার শিকার, বাণিজ্য এবং পরিবহন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আইন লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড, অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
তবুও, এই মাছের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি, যা পরিবেশ ও প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাগাড় মাছের গুরুত্ব ও সংরক্ষণ
বাগাড় মাছ (মেহেরি মাছ) দক্ষিণ এশিয়ার বড় বড় নদীতে পাওয়া যায়, বিশেষত পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীতে। এটি মিষ্টি পানির একটি অত্যন্ত মূল্যবান মাছ, যা নদীর বাস্তুসংস্থান ও জলের মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। বাগাড় মাছের অবস্থা আজ বিপর্যস্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে অবৈধ শিকার, বন্য প্রাণী হত্যার কারণে প্রজনন কমে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ এবং নদীর জলস্তরের পরিবর্তন।
বাগাড় মাছের সংরক্ষণে সরকার এবং পরিবেশবাদীরা নিয়মিত সচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এর শিকার ও বাণিজ্য নিষিদ্ধ হলেও enforcement-এর অভাবে এখনও অনেক এলাকায় অবৈধ বাগাড় মাছের বেচাকেনা চলছে।
পদ্মা নদীর ইকোসিস্টেমে বাগাড় মাছের ভূমিকা
পদ্মা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদী। এই নদীর জলজ বাস্তুসংস্থানে বাগাড় মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা নদীর খাদ্যশৃঙ্খলে শীর্ষে অবস্থান করে, যা অন্যান্য ছোট মাছ ও প্রাণীদের জীবন চালানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করে। বাগাড় মাছ কমে গেলে নদীর ইকোসিস্টেমে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
অবৈধ মাছ শিকার ও আইন: সমস্যার গভীরতা
বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে বাগাড় মাছসহ বিরল প্রজাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু নিয়মিত শিকার ও অবৈধ বিক্রির খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যাতে এই অপরাধ বন্ধ করা হয়।
আইন অনুসারে, এই মাছ শিকার বা বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি থাকলেও, enforcement না থাকার কারণে অবৈধ কার্যক্রম চলছে। এতে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “বাগাড় মাছের সংরক্ষণ খুব জরুরি। নদীর পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। অবৈধ শিকার ঠেকাতে প্রশাসনের কড়া নজরদারি প্রয়োজন।”
তারা আরও উল্লেখ করেছেন, স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং বিকল্প আয় উৎস সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা অবৈধ শিকার থেকে বিরত থাকে।
সমাধানের দিকনির্দেশনা
১. কঠোর আইন প্রয়োগ: অবৈধ মাছ শিকার ও বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয়দের মধ্যে প্রকৃতির সংরক্ষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
৩. বিকল্প জীবিকা: মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. নদী পরিবেশ রক্ষা: নদী দূষণ ও জলস্রোত রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
৫. গবেষণা ও মনিটরিং: বাগাড় মাছের প্রজনন ও পরিবেশগত অবস্থা নিয়ে গবেষণা করা জরুরি।
রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে ধরা পড়া ৫০ কেজির মহাবিপন্ন বাগাড় মাছের ঘটনা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সংকট ও সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। অবৈধ বাগাড় মাছের বাণিজ্য বন্ধ না হলে প্রজাতির বিলুপ্তি অনিবার্য। তাই সরকার, প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত উদ্যোগে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই বিরল মাছের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব উপভোগ করতে পারে।