প্রযুক্তি

নতুন রক্তের গ্রুপ ‘গোয়াডা নেগেটিভ’: ফ্রান্সে বিরল রক্তের গোপনীয়তার উন্মোচন

রক্তের গ্রুপ নিয়ে মানুষের জ্ঞানে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে ফ্রান্স থেকে। দেশের জাতীয় রক্ত সঞ্চালন সংস্থা ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ব্লাড এস্টাবলিশমেন্ট’ সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা নতুন একটি রক্তের গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। এই নতুন গ্রুপের নাম রাখা হয়েছে ‘গোয়াডা নেগেটিভ’। এটি একেবারে বিরল এবং এর আগে বিশ্বে শনাক্ত হয়নি।

গোয়াডা নেগেটিভ: বিরল রক্তের এক নতুন ধারা

গোয়াডা নেগেটিভ রক্তের গ্রুপটি ফরাসি এক নারীর শরীরে পাওয়া গেছে, যিনি প্রায় ১৫ বছর আগে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ গুয়াদেলুপ থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন। ২০১১ সালে ওই নারীর অস্ত্রোপচারের আগে নেওয়া রক্তের নমুনা পর্যালোচনা করার সময় এই অদ্ভুত রক্তের ধরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে সেই নমুনার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা একটি বিরল জেনেটিক মিউটেশন শনাক্ত করেন, যা গোয়াডা নেগেটিভ রক্তের গ্রুপের পেছনের রহস্য উদঘাটন করে।

কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ?

মানুষের রক্তের গ্রুপ সাধারণত চারটি মূল ভাগে ভাগ করা হয়—এ (A), বি (B), এবি (AB), এবং ও (O)। প্রতিটি গ্রুপ আবার পজিটিভ ও নেগেটিভ দুই ভাগে বিভক্ত। এই বর্ণনা যতই সাধারণ মনে হয়, মানুষের রক্তের জটিলতা তা থেকে অনেক বেশি গভীর। নতুন জেনেটিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই গ্রুপগুলোর ভেতরেও আরও অজানা, বিরল ও গোপনীয় রক্তের ধরন আবিষ্কৃত হচ্ছে।

বিজ্ঞানী থিয়েরি পেয়ারার্ডের মতে, ‘গোয়াডা নেগেটিভ’ রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার হওয়া মানে রক্তের বৈচিত্র্যের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে রক্ত সংক্রান্ত চিকিৎসা ও ট্রান্সফিউশনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রাখে।

১৫ বছর আগে শুরু হওয়া রহস্য

২০১১ সালে ওই ফরাসি নারীর রক্তে বিরল এক অ্যান্টিবডি পাওয়া গেলেও, পরীক্ষাগারের বিশ্লেষণ দীর্ঘদিন বিলম্বিত হয়। পরে ২০১৯ সালে উন্নত ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই রক্তের মধ্যে বিরল জেনেটিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।

এটি নির্দেশ করে, মানুষের শরীরে থাকা জেনেটিক মিউটেশন ও রক্তের গুণগত বৈচিত্র্যের মাত্রা অনেক বেশি। এই নতুন আবিষ্কার থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, মানুষের রক্তের বিশ্বে এখনও অনেক অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে।

রক্তের নতুন গ্রুপ আবিষ্কারের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ

রক্তের গ্রুপ সম্পর্কে জ্ঞানের এই অগ্রগতি শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে নয়, জেনেটিক গবেষণার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। যেমন:

  • রক্ত সঞ্চালন ও চিকিৎসায় উন্নতি: বিরল রক্ত গ্রুপের রোগীদের জন্য উপযুক্ত রক্তের খোঁজ আরও সহজ হবে।
  • জেনেটিক গবেষণায় নতুন দিক: মানব জেনেটিক বৈচিত্র্যের গভীরতর বিশ্লেষণ সম্ভব হবে।
  • বিরল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: কিছু বিরল রোগের কারণ হিসেবে জেনেটিক মিউটেশন কাজ করতে পারে, যা গবেষণার নতুন সুযোগ এনে দেবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রক্ত সঞ্চালন সংস্থা ইতোমধ্যে ‘গোয়াডা নেগেটিভ’ রক্তের গ্রুপকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই আবিষ্কারের গুরুত্ব ও বৈধতা নিশ্চিত করে।

রক্তের বিশ্বে নতুন অধ্যায়: ইতিহাস ও আধুনিকতা

রক্তের গ্রুপের প্রথম শ্রেণিবিভাগ প্রায় এক শতাব্দী আগে আবিষ্কৃত হয়। তখন থেকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে, অনেক নতুন তথ্য ও আবিষ্কার মানুষের সামনে এসেছে। এই নতুন আবিষ্কারগুলি আমাদের রক্তের গঠনের গভীরতর ও বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার হবে। কারণ মানুষের ডিএনএ গবেষণার ক্ষেত্র এখন অসীম বিস্তারের পথে।

সামাজিক প্রভাব ও সচেতনতা

রক্তের এমন বিরল গ্রুপের আবিষ্কার রোগীদের জন্য আশার আলো জাগিয়েছে। বিশেষ করে যারা বিরল রক্তের কারণে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা ভুগছেন তাদের জন্য নতুন রক্তের গ্রুপের সন্ধান জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়াও, এই আবিষ্কার স্বাস্থ্যখাতে গবেষণা ও উন্নয়নে নতুন পথ প্রশস্ত করবে, যেখানে দেশের রক্ত ব্যাংক ও হাসপাতালগুলোকে এই নতুন তথ্য জানিয়ে, রোগীদের চিকিৎসার মান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button