দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের নতুন নাম: ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’

বাংলাদেশের প্রথম ছয়লেনের এক্সপ্রেসওয়ের নাম পরিবর্তন, নতুন নাম ঘোষণা
বাংলাদেশের দ্রুততম এবং দেশের প্রথম ছয়লেন জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এই মহাসড়কের নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’। বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
প্রাথমিক নামকরণ ও বাস্তব পরিচিতি
২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ করা হয়েছিল ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’ হিসেবে। তবে জনসাধারণের কাছে এটি দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত ছিল ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’ নামে। তাই, নতুন নামকরণের মধ্য দিয়ে মূল পরিচয় বজায় রাখা হয়েছে।
ইতিহাস ও নাম পরিবর্তনের পেছনের কারণ
২০২২ সালে ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় সরকারিভাবে মহাসড়কটির নামের ফলক স্থাপন করা হয় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’ নামে। কিন্তু ২০২৪ সালে ছাত্র ও জনতা জন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় এলাকাবাসী পূর্বনির্ধারিত ফলক সরিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে ‘জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এক্সপ্রেসওয়ে’ নামের ব্যানার টানিয়ে দেন। এই বিতর্কিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন করে নামকরণ করে বাস্তবিক নামেই সড়কটিকে পরিচিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের ভৌগলিক বিস্তার ও গুরুত্ব
ঢাকা জেলা, যাত্রাবাড়ি থেকে শুরু করে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান, শ্রীনগর ও লৌহজং উপজেলার মধ্য দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এই এক্সপ্রেসওয়ের যাত্রা শেষ হয়। মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ কিলোমিটার।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যের দ্রুত গতি বৃদ্ধিতে এই এক্সপ্রেসওয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশেষ করে, পদ্মা সেতুর সংযুক্তির মাধ্যমে এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্যের পরিবহন অনেক সহজ করে তুলেছে। এটি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নির্মাণ ব্যয় ও বাস্তবায়ন
এক্সপ্রেসওয়ের মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (পশ্চিম) এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছে।
মহাসড়কটি মূলত চার লেনের হলেও এতে মোট ছয় লেনের রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, যার মধ্যে দুই লেন সার্ভিস লেন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে যান চলাচল নিরাপদ ও দ্রুততর হয়।
এক্সপ্রেসওয়ের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
এই আধুনিক এক্সপ্রেসওয়ের অবকাঠামো অত্যন্ত উন্নত। এর মধ্যে রয়েছে:
- ৫টি ফ্লাইওভার
- ১৯টি আন্ডারপাস
- ২টি ইন্টারচেঞ্জ
- ৪টি রেলওয়ে ওভারব্রিজ
- ৪টি বড় সেতু
- ২৫টি ছোট সেতু
- ৫৪টি কালভার্ট
এই অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে যান চলাচলে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটেনা এবং ট্রাফিক প্রবাহ নির্বিঘ্নে পরিচালিত হয়।
পদ্মা সেতু সংযুক্তির ফলে এক্সপ্রেসওয়ের গুরুত্ব
পদ্মা সেতু দেশের সবচেয়ে বড় সেতু এবং এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ নিশ্চিত করেছে। ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’ এই সেতুর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হয়ে উঠেছে।
এতে শুধু যাত্রীবাহী যানবাহন নয়, পণ্য পরিবহন ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। কৃষি ও শিল্প পণ্য সরবরাহে এটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক্সপ্রেসওয়ের অবদান
বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগের আধুনিকীকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’ একটি মাইলফলক। এটি শুধু যাতায়াতের সময় কমায় না, দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ করে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুর্লভ জেলার মানুষের জন্য এটি একটি আশীর্বাদস্বরূপ। দ্রুত সড়ক যোগাযোগের ফলে শিক্ষার্থী, রোগী, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
বর্তমানে চলমান এই এক্সপ্রেসওয়েটি দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যতে আরও উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকার উচ্চ মানসম্পন্ন সড়ক নির্মাণ, আধুনিক টোল ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ের কার্যকারিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে।
এছাড়া, মহাসড়কের পাশে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এলাকাবাসীর সুবিধার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে রাস্তা সংযোগ এবং ভ্রমণ ব্যবস্থার উন্নয়নও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সারসংক্ষেপ
- বাংলাদেশের প্রথম ছয়লেন জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ের নাম পরিবর্তন হয়ে হলো ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’।
- ২০১৯ সালে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’ নামে নামকরণ হলেও, সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি ছিল পুরোনো নামেই।
- ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।
- নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১১ হাজার ৪ কোটি টাকা।
- অবকাঠামোতে রয়েছে ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ইন্টারচেঞ্জ, সেতু এবং কালভার্ট।
- পদ্মা সেতুর সংযুক্তির কারণে এর গুরুত্ব দ্বিগুণ হয়েছে।
- দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলা রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে।
- দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক্সপ্রেসওয়ের ভুমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশের উন্নয়নকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথে ‘ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে’ দেশের অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই মহাসড়ক শুধু সড়ক নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান সোপান।