ভারতের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ বাদ চায় আরএসএস

ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও এক বিতর্কিত প্রস্তাব উঠে এসেছে। ভারতের এক অন্যতম কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবল দাবি করেছেন, ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনামূলক অংশ থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া উচিত। তার মতে, এই দুটি শব্দ ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকারের একচ্ছত্র সিদ্ধান্তে সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল, যা ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত চরিত্রের পরিপন্থী।
১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার স্মৃতি ও সংবিধানে সংশোধনী
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ভারতের পুরো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। প্রায় ২১ মাস স্থায়ী এই জরুরি অবস্থাকে ভারতীয় রাজনীতি ও ইতিহাসে একটি ‘অন্ধকারতম অধ্যায়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে কংগ্রেস সরকার সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি সংযোজন করে, যা পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধান ও রাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে গণ্য হয়।
নয়াদিল্লিতে গত বৃহস্পতিবার ‘ভারতের জরুরি অবস্থার ৫০ বছর’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় আরএসএস নেতা দত্তাত্রেয় হোসাবল বলেন, “১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় কংগ্রেস সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল। সেই সময়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি যোগ করা হয়েছিল, তা আজও বহাল রাখা কি যুক্তিযুক্ত?”
আরএসএসের কড়া প্রতিক্রিয়া: ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
হোসাবল বলেন, “ভারতের প্রকৃত সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক চিত্র হিন্দু ধর্ম ও সমাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সে জন্য সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি থাকা উচিত নয়। ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়, বরং এটি একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বরূপ থাকা উচিত।”
তিনি আরও যুক্তি দেন, সমাজতন্ত্রের ধারণাটি ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়, কারণ এটি ভারতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে আরএসএস স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা ভারতীয় সংবিধানের এমন মৌলিক অংশগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছে, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
রাজনৈতিক মহলে এবং বিচারব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়া
এর আগে ভারতের শাসক দল বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতা সুপ্রিম কোর্টে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ দুটি সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঐ আবেদন খারিজ করে দেয়।
সুপ্রীম কোর্টের সেই রায়ের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে ভারত আজও তার ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে অটল থাকতে চায়।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে হচ্ছে রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেও প্রধান্য দেয় না বা কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। এটি ভারতের বহুধর্ম, বহুভাষা ও বহুসংস্কৃতির পরিচয়ের এক প্রতীক।
‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি ভারতকে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে গরিব ও অসহায়দের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়।
এই দুটি শব্দ ভারতের গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে, যা ভারতকে একটি সমতা ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
সমালোচনা ও সমর্থনের দ্বন্দ্ব
আরএসএস নেতার এই বক্তব্যে সমালোচকরা এটিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই দাবিগুলো ভারতের বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতির বিরুদ্ধে একটি আক্রমণ হতে পারে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী প্রবণতা বাড়ার ধারাকে আরও প্রবল করে তুলবে।
অন্যদিকে, আরএসএস ও তার সমর্থকরা মনে করেন, ভারতীয় সংবিধানের এই অংশগুলো ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এগুলো দেশকে বিভক্ত করার পথ তৈরি করছে।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট: ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব
এই ধরনের দাবি রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও হিন্দুত্ববাদী দলের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্যে, সংবিধানের এই মৌলিক অংশগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও উত্তেজনা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক পরিচয় রক্ষা করতে হলে এই ধরনের বিতর্ক গুলোকে সংযম ও বৌদ্ধিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
সারসংক্ষেপ
- আরএসএস সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবল ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় সংবিধানে যুক্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার দাবি জানান।
- ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই শব্দ দুটি সংযোজন করেছিল।
- বিজেপি নেতৃবৃন্দও পূর্বে এই শব্দ দুটি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করলেও সুপ্রিম কোর্ট আবেদনটি খারিজ করে দেয়।
- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দগুলো ভারতের গণতন্ত্রের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত।
- এই দাবির ফলে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আলোচনায় নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।