অর্থনীতি

ঋণ করে বেতন, ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধে দেশের অর্থনীতি সংকটাপন্ন

দেশের অর্থনীতি নিয়ে সতর্ক সংকেত দিলো বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশন (পিআরআই)। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীতে পিআরআইর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাজেট পর্যালোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো দেশের রাজস্ব আয় সরকারের পরিচালন ব্যয় ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকারকে চলতি বেতন, ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণ থেকে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বেশ উদ্বেগের বিষয়।

এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। এছাড়া বাজেট ব্যবস্থাপনায় সংশোধন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও তারা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন।

ঋণ ভরসায় চলতি ব্যয় বৃদ্ধি: উদ্বেগ ছড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনীতিবিদরা

পিআরআইর চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার ও প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান যৌথভাবে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেন। আশিকুর রহমান বলেন,

“২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সরকারের পরিচালন ব্যয় রাজস্ব আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্থ হলো আমরা বেতন, ভর্তুকি ও সুদের জন্য ঋণ নিচ্ছি। এর ফলে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দও কমে আসছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকার আশেপাশে পৌঁছাতে পারে, যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।”

তিনি আরও বলেন,

“সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমানো না গেলে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হবে। তাই বাজেট ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীলতা ও কার্যকরী পরিকল্পনার বিকল্প নেই।”

তরুণদের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির সংকট

জাইদি সাত্তার বলেন, প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ তরুণ কর্মসংস্থলের জন্য বাজারে প্রবেশ করছে, যেখানে বিদেশে কর্মসংস্থানের খোঁজে যাচ্ছে প্রায় ১০ লাখ তরুণ। বাকি ১৪ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে করের উচ্চ হার ও রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্য সংকট এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে।

“টাকার অবমূল্যায়ন (৪০ শতাংশ) থাকলেও বাজেটে এর সঠিক সমন্বয় নেই। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে।”

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন,

“চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে গিয়ে জিডিপির ১ শতাংশে নেমেছে এবং বৈদেশিক আয় বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক।”

সড়ক, নৌ, বিমান ও রেল বিভাগ একক মন্ত্রণালয়ে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা

সদস্য সচিব শেখ মইনউদ্দিন বলেন,

“দেশের সড়ক, নৌ, বিমান ও রেল বিভাগগুলো এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা উচিত। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্প অনুমোদন থেকে বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে প্রকল্প বিলম্বিত হয় ও খরচ বাড়ে।”

তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকায় কাজের সময় তিনি দেখেছেন বিভিন্ন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা থাকার কারণে সড়ক ব্যবস্থাপনা জটিল ও অকার্যকর হচ্ছে। খুলনাতেও সেতু থাকলেও সড়কের অভাব বিদ্যমান যা সমন্বয়ের অভাবে ঘটছে।

ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীর উদ্বেগ

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান জানিয়েছেন,

“গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে ৯ থেকে ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েছেন এবং সরকারের রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি তাদের আরও চাপের মুখে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমর্থন পাচ্ছে না।”

তিনি আরও যোগ করেন,

“এসএমই খাত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনও প্রস্তুত নয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় সংকট।”

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগীদের কর বৃদ্ধি: ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন,

“ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগীরা ইতোমধ্যে নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ভ্যাট বাড়ানো হলে তারা টিকে থাকা আরও কঠিন হবে।”

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক সমন্বয়

অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনের উপপ্রধান ক্লিনটন পোবকে এবং পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক খুরশিদ আলমও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বে বাজেট প্রণয়ন ও নীতি গ্রহণ জরুরি।

সার্বিক বিশ্লেষণ ও সমাধানের দিকনির্দেশনা

১. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা: প্রথমবারের মতো রাজস্ব আয়ের তুলনায় পরিচালন ব্যয়ের অধিকতা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুতর সংকেত।
২. ঋণ নির্ভরতা: চলতি ব্যয় নির্বাহে ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ভবিষ্যতে বাজেটের ভারসাম্যহীনতার কারণ হতে পারে।
৩. কর্মসংস্থান: তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
৪. মন্ত্রণালয় সমন্বয়: যোগাযোগ খাতের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোকে একত্রিত করার গুরুত্ব।
৫. ব্যবসায়িক পরিবেশ: কর ব্যবস্থা ও ঋণের সুদের হার কমিয়ে ব্যবসায়িক খাতকে প্রণোদনা দেয়া জরুরি।
৬. বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ: রিজার্ভ বাড়ানো ও রপ্তানিকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থান শক্তিশালী করা।

পিআরআইর এই বাজেট পর্যালোচনা সভা দেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকট ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ নির্দেশ করেছে। ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে, কার্যকর বাজেট পরিকল্পনা গ্রহণ ও তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে দেশের অর্থনীতি সুস্থ ও স্থিতিশীল হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে একত্রিত করে প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন ও ব্যবসায়ীদের কর ও ঋণের বোঝা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নত করার জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button