বিশ্ব

বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো ইরান

ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করায় বাংলাদেশের সরকার, জনগণ এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাস। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তিতে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের এই কূটনৈতিক মিশন।

বিজ্ঞপ্তিতে ইরান দূতাবাস জানায়, “ইসরায়েল ও তার সমর্থকদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, তা কেবল একটি রাজনৈতিক বার্তা নয়; বরং তা মানবিকতা, ন্যায়বিচার এবং জাতিসত্তার মর্যাদার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের গভীর অঙ্গীকারের প্রকাশ।”

এই বিবৃতিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেখানে বিশ্বজুড়ে একপাক্ষিকতা, ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও আধিপত্যবাদের বেড়াজালে মানবিকতা প্রায়শই গৌণ হয়ে পড়ে, সেখানে বাংলাদেশের জনগণের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো।

শান্তিপূর্ণ সংহতি: ন্যায়বিচার ও মানবিকতার পক্ষে একটি দৃঢ় বার্তা

ইরান দূতাবাসের বিবৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ, শিক্ষাবিদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সহানুভূতিশীল বক্তব্য, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং বিবৃতিগুলোর কথা। এসব কার্যক্রমকে “মানবিক সচেতনতা ও ন্যায়ের পক্ষে এক গভীর প্রতিশ্রুতি” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের জনমত ও গণপ্রতিক্রিয়া কেবল একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতিকেই প্রভাবিত করে না; বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শামীম আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে মনোভাব প্রকাশ করেছে, তা কেবল মানবিকতার দিক থেকে নয়—রাজনৈতিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। এটি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক অবস্থান দেখিয়েছে।”

ইরানি জনগণের প্রতিরোধ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকার

বিজ্ঞপ্তিতে ইরান নিজ দেশের জনগণের প্রতিরোধকে “জাতীয় ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন” হিসেবে বর্ণনা করে। বলা হয়, “এই প্রতিরোধ ইরানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিচ্ছবি। এটি আধিপত্যবাদ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সামনে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।”

ইরান এও স্পষ্ট করে জানায় যে, প্রতিরোধ তাদের কাছে কেবল একটি কৌশলগত পদক্ষেপ নয়, বরং এটি একটি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। এই বক্তব্যের মাধ্যমে ইরান তার ঐতিহাসিক অবস্থান ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

আঞ্চলিক রাজনীতি ও মুসলিম উম্মাহর সংহতি

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের এই বিবৃতি শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একটি বৃহৎ সংহতির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এবং গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ভয়াবহ আগ্রাসন বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জনগণের অবস্থান, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ, সামাজিক মাধ্যমে জনমত, এবং নাগরিক সমাজের সোচ্চারতা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সাবেক সদস্য মো. রাশেদুল হক বলেন, “এই সময় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংহতি যতটা জরুরি, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ ও জনমত সৃষ্টি। বাংলাদেশ সেই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”

বাংলাদেশ-ইরান সম্পর্ক: আরও গভীরতায়

ইরানের পক্ষ থেকে এমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এক ধরনের কূটনৈতিক বার্তা বহন করে। দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিবাচক প্রবাহকেই এর মাধ্যমে শক্তিশালী করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিশেষত অর্থনীতি, বাণিজ্য, জ্বালানি এবং সংস্কৃতি—এই চারটি খাতে বাংলাদেশ ও ইরান ভবিষ্যতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী।

ঢাকায় নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত অতীতে একাধিকবার বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের কথা বলেছেন। এই ধরনের মানবিক যোগাযোগ ও কৃতজ্ঞতা সম্পর্কের ভিতকে আরও মজবুত করতে সহায়ক হতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক বার্তা

বিশ্ব রাজনীতিতে যেসব দেশ ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের প্রতি ইরানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে একধরনের কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ইরান তার সমর্থকদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক সমর্থনেরও একটা আভাস দিচ্ছে।

বিশেষ করে জাতিসংঘ, ওআইসি, এশিয়ান সহযোগিতা ফোরামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ইরান ও তার সমর্থকদের বার্তাটি খুব স্পষ্ট: মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে সম্মিলিত অবস্থান গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

উপসংহার: মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সংহতির এক অনন্য নজির

ঢাকার ইরান দূতাবাসের বিবৃতি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক কৃতজ্ঞতাই নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি শক্তিশালী বার্তা—সাংবাদিকতা, সামাজিক আন্দোলন, শিক্ষাঙ্গন ও নাগরিক সমাজ সম্মিলিতভাবে যখন মানবতার পক্ষে কথা বলে, তখন তা কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাস্তব পরিবর্তনের পথও তৈরি করে।

বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের এই অবস্থান ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ফোরামে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। একইসঙ্গে এটি মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার পথকেও সুগম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button