গাজায় ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সরবরাহের সরাসরি পথ বন্ধ করল ইসরায়েল

যুদ্ধবিধ্বস্ত উত্তর গাজায় মানবিক সংকট চরমে
ইসরায়েল সরকার উত্তর গাজার ত্রাণ সরবরাহের সরাসরি রুট বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট ঘনিয়ে এসেছে। ফলে সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে, যারা এমনিতেই খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার মারাত্মক ঘাটতির মুখে রয়েছেন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বহুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছিল যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা ভূখণ্ডে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছালে তা “পুরোমাত্রার দুর্ভিক্ষ”-এর দিকে ঠেলে দিতে পারে পরিস্থিতিকে। এবার ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত সেই ভয়কেই বাস্তবে রূপ দিতে চলেছে।
উত্তরের রুট বন্ধ, দক্ষিণ দিয়ে সীমিত প্রবেশ
ইসরায়েল সরকার বৃহস্পতিবার উত্তর গাজার সব কটি প্রবেশপথ বা ক্রসিং পয়েন্ট বন্ধ করে দেয়। এই রুটগুলোই ছিল সরাসরি ত্রাণ প্রবেশের প্রধান পথ। যদিও দক্ষিণাঞ্চলের কিছু সীমান্ত দিয়ে এখনো সামান্য পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুজন ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি কর্মকর্তা।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে হামাসের ত্রাণ চুরির অভিযোগের প্রেক্ষিতে। তারা বলছে, গাজার অভ্যন্তরে ত্রাণ পাচারের সময় হামাস সদস্যরা তা জোরপূর্বক দখল করে নিচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে দিচ্ছে না।
মুখোশধারীদের পাহারা, সংঘবদ্ধ নিরাপত্তা
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি ত্রাণবাহী ট্রাকের ওপর বসে আছে এবং সেগুলোর পাহারা দিচ্ছে। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর দাবি, এটি হামাসের দখল ঠেকাতে স্বেচ্ছাসেবী পাহারা ব্যবস্থা। কেউ কেউ বলছে, এই পাহারার উদ্যোগ আসলে জনগণের নিরাপত্তার জন্য গঠিত হলেও, তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
এই ঘটনার পরপরই ইসরায়েল উত্তরের ক্রসিং বন্ধ করে দেয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, এখন থেকে কেবল দক্ষিণ দিক থেকেই ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি থাকবে, যদিও সেটিও সীমিত আকারে।
ইসরায়েলের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের মুখপাত্র ডেভিড বলেন, “দক্ষিণ গাজা দিয়ে ত্রাণ ঢুকছে, তবে উত্তর গাজায় ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে নিরাপত্তার কারণেই।” এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি তিনি, ত্রাণ প্রবাহ ঠিক কোন ক্রসিং দিয়ে কিভাবে চলছে, তার ব্যাখ্যাও দেননি।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গালান্ত এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, “হামাস যেন কোনওভাবেই ত্রাণ দখল করতে না পারে, সে জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছি।”
হামাস অবশ্য ইসরায়েলের এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য, ত্রাণের প্রতিটি চালান যথাযথভাবে বিতরণ করা হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে।
কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে, স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর কঠোর মন্তব্য
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ এবং মানবাধিকার সংগঠন বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, “ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ মানবিক সহায়তা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। এটি মূলত গাজার সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ।” তিনি এটিকে “গণহত্যার পর্যায়ে” পৌঁছাতে পারে এমন ভয়াবহ সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল একটি সহযোগিতা চুক্তির আওতায় গাজার মানুষের মানবাধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতায় রয়েছে। এই বাধ্যবাধকতা তারা চরমভাবে উপেক্ষা করছে।”
জাতিসংঘ ও এনজিওগুলোর সতর্কবার্তা
জাতিসংঘ, রেড ক্রস, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও সম্প্রতি গাজায় খাদ্য, পানি ও ওষুধের হাহাকার নিয়ে একাধিকবার সতর্কবার্তা দিয়েছে। তাদের মতে, বিশেষ করে উত্তর গাজা অঞ্চলে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের একজন মুখপাত্র বলেন, “যদি উত্তরের সরবরাহ বন্ধ থাকে এবং জনগণের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গড়ে না ওঠে, তাহলে এই অঞ্চলটি গণহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে বলেই আমরা আশঙ্কা করছি।”
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে ইসরায়েল
যদিও আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ বারবার গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে, ইসরায়েল সেসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে।
ইসরায়েলের বক্তব্য হলো, তারা কেবলমাত্র সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে লিপ্ত এবং গাজার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কোনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ নেয়নি। তবে বাস্তবতা হলো, তাদের নীতির বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণির নাগরিকরা।
পরিশেষে
উত্তর গাজায় সরাসরি ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন হতাশাজনক, তেমনি এটি আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনক এক পদক্ষেপ। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের অবস্থান আরও চাপে পড়তে পারে। এই সংকটে সমাধান খুঁজতে প্রয়োজন আন্তঃজাতিক ঐক্য, দায়িত্বশীল কূটনীতি এবং মানবতার জয়।