ধামাকার ‘৬২ কোটি টাকার’ সম্পত্তি জব্দ

ই-কমার্স খাতে আলোচিত প্রতারণা কেলেঙ্কারির একটি চাঞ্চল্যকর অধ্যায় সামনে এসেছে। ধামাকা শপিং নামের অনলাইন বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) জানিয়েছে, ধামাকা শপিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা প্রায় ৬২ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশে সম্পদ জব্দ
সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ জুন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত এ আদেশ দেন। বৃহস্পতিবার সিআইডির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ধামাকা শপিং গ্রাহকদের প্রায় ১১৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং এর একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা প্রায় সবাই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে রয়েছে ধামাকা শপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন চিস্তীর নামে বনানী মডেল টাউনে নির্মিত প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বহুতল ভবন। এ ছাড়া মাইক্রো ট্রেড ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড-এর নামে গাজীপুরের কাশিমপুর পূর্ব বাগাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৪১ শতাংশ জমিও জব্দ তালিকায় রয়েছে।
ভুয়া প্রতিষ্ঠানের আড়ালে পরিচালিত হয় ‘ধামাকা শপিং’
সিআইডি জানায়, ধামাকা শপিং নামে অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর কিংবা সিটি করপোরেশন থেকে কোনো নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এটি ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল। প্রতিষ্ঠানটি ‘স্বল্প মূল্যে পণ্য সরবরাহের’ প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার গ্রাহক ও বিক্রেতার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক জালিয়াতি
একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো—ধামাকা শপিংয়ের নিজস্ব কোনো ব্যাংক হিসাব ছিল না। তারা ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের নামে সাউথইস্ট ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একাধিক হিসাবের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন চালিয়ে যেত।
বিশেষ করে সাউথইস্ট ব্যাংকের একটি হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫৮৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। অথচ ২০২১ সালের ২৭ জুন হিসাবটিতে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৩১ টাকা ছিল, যা সিআইডির মতে অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং আর্থিক জালিয়াতির সুস্পষ্ট প্রমাণ।
মানি লন্ডারিংয়ের চিত্র
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ অর্থ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন চিস্তী ও তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নামে মাইক্রো ট্রেড ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়।
এ কার্যক্রম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এমনকি কয়েকটি অ্যাকাউন্টে এই অর্থ বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই অবৈধভাবে স্থানান্তর করা হয়। ফলে এসব লেনদেন মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হয়।
মামলা ও তদন্ত
ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি পরে তদন্তের জন্য সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, অর্থ আত্মসাতের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এতে জড়িতদের অধিকাংশই বর্তমানে বিদেশে পলায়নপর।
তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আসামিদের ফিরিয়ে আনা এবং পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
কীভাবে ঘটল প্রতারণা?
ধামাকা শপিং শুরুতে আকর্ষণীয় অফার, বিশাল ডিসকাউন্ট এবং ফ্ল্যাশ সেল-এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। গ্রাহকরা ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতেন। কিন্তু পণ্য সরবরাহ হতো না কিংবা নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আসত। শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং দায় অস্বীকার করে।
ভুক্তভোগীদের দুর্দশা
ধামাকা শপিংয়ের প্রতারণার শিকার হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার গ্রাহক ও ছোট ব্যবসায়ী। অনেকেই পণ্য না পেয়েও টাকা ফেরত পাননি। অনেকে নিজেদের সঞ্চয় কিংবা ঋণের টাকা দিয়ে অর্ডার করেছিলেন, যা পরে ডুবে যায়।
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বারবার ‘ডেলিভারি বিলম্ব হচ্ছে’ বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে তা ছিল ধোঁকা। শেষ পর্যন্ত ফোন বন্ধ হয়ে যায়, ওয়েবসাইট বন্ধ হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা গা ঢাকা দেন।
রাষ্ট্রীয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে গ্রাহকদের রক্ষায় নিয়ন্ত্রণমূলক তদারকি এবং নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা দরকার। তারা বলেন, ই-কমার্স খাতে কঠোর নীতিমালা ও কার্যকর নজরদারির অভাবেই এমন কেলেঙ্কারির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অর্থ পুনরুদ্ধার এবং আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনাই হওয়া উচিত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মূল লক্ষ্য।
শেষ কথা
ধামাকা শপিং কেলেঙ্কারির ঘটনা বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের প্রতি জনগণের আস্থা হরণের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন এই আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সিআইডির জব্দ করা সম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার লড়াইটা এখনও বাকি।