অর্থনীতি

অস্থিরতার মধ্যেও ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে বড় সাফল্য বাংলাদেশে

চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চমকপ্রদ বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ইউরোপে ৮০৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ ও গ্যাস সংকট—সব বাধা পেরিয়ে এই প্রবৃদ্ধি দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করে।

ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অবস্থান

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশই আসে এই অঞ্চল থেকে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে বাংলাদেশ ইউরোপে রপ্তানি করেছে ৮০৭ কোটি (৮.০৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক, যেখানে গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৬৫১ কোটি ডলার। এই তথ্য ইউরোস্ট্যাট সূত্রে পাওয়া গেছে।

চীন এখনও শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশ দ্রুতই তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। একই সময়ে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৩৮ কোটি ডলার। মাত্র ৩১ কোটি ডলারের ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অস্থিরতা ও সংকট—প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ

গত বছর ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ নেতিবাচক ধারা দেখেছিল। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়কালে প্রবৃদ্ধি ছিল মাইনাস ২.০৬ শতাংশ। মূলত শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও জ্বালানিসংকট এর পেছনে দায়ী ছিল।

অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, কিছু ক্ষেত্রে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। তবে বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ, যার ফলে বছর শেষে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে।

নিট পোশাক খাতের উত্থান

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির দুই প্রধান উপখাত—ওভেন ও নিট। করোনা পরবর্তী সময়ে নিট পোশাকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বেড়ে যায়।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-মে সময়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী:

  • মোট পোশাক রপ্তানি আয়: ৩৬.৫৬ বিলিয়ন ডলার
  • নিট পোশাক: ১৯.৬২ বিলিয়ন ডলার
  • ওভেন পোশাক: ১৬.৯৪ বিলিয়ন ডলার

বিশ্বব্যাপী আরামদায়ক, দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাকের চাহিদা বাড়ায় নিট পোশাক শিল্প ভালো করছে। এতে প্রধান পণ্য হিসেবে আছে টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার ইত্যাদি।

অন্যান্য প্রতিযোগীদের অবস্থান

বাংলাদেশের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামও উল্লেখযোগ্য রপ্তানি করেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি চিত্র:

দেশরপ্তানির পরিমাণ (বিলিয়ন ডলার)প্রবৃদ্ধি (%)
চীন৮.৩৯২১.৪৯
বাংলাদেশ৮.০৭২৪.০০
তুরস্ক৩.১০-৫.৪১
ভারত২.০১২০.৫৮
কম্বোডিয়া১.৫৬৩১.৭৮
পাকিস্তান১.৪২২৩.৪২

এখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার চীনের চেয়ে বেশি হলেও, রপ্তানির পরিমাণে সামান্য পিছিয়ে আছে। তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে শীর্ষে উঠে আসা সময়ের ব্যাপার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কী বলছেন শিল্প নেতারা?

বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন,

“জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানায় হামলা-ভাঙচুর হলেও আমরা রপ্তানিতে ভালো করতে পেরেছি। এটি আমাদের খাতের টেকসই সক্ষমতার প্রমাণ। তবে সামনে কী হবে তা বলা কঠিন, বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।”

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন,

“ইইউতে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে হলে নতুন নিয়মনীতি অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। টেকসই উৎপাদন ও দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।”

উপসংহার

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শুধু পরিমাণে নয়, গুণগত মান ও টেকসই উৎপাদনেও এগিয়ে যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, শ্রম সমস্যা ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও ইউরোপে রপ্তানিতে এমন চমকপ্রদ সাফল্য দেশের অর্থনীতির জন্য আশার আলো। তবে এই ধারা টিকিয়ে রাখতে হলে সরকার, উদ্যোক্তা ও শ্রমিক—তিন পক্ষের সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন।

এম আর এম – ০০৬৩, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button