বাংলাদেশ

সীমান্তে ঠেলে দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম থেকে বাংলাদেশে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বহু মুসলিম নাগরিককে, যাদের অধিকাংশই আসামের স্থানীয় বাসিন্দা এবং বাংলাভাষী। তারা মূলত ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু বিভিন্ন নথিপত্রের অমিলকে কেন্দ্র করে ‘বিদেশি’ বা ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে নির্যাতন করা হচ্ছে।

২৪ জুন আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, এই অসহায় মানুষেরা সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে নিরাপত্তাহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আসামের সাইকেল মেকানিক আলীর দুর্ভোগ

৬৭ বছর বয়সী আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে আসামে বসবাস করছেন, ২৩ মে হঠাৎই পুলিশের হাতে আটক হন। মোরিগাঁও জেলার কুইয়াদল গ্রামে তাঁর ভাড়া বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসামের মাতিয়া বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়। পরে বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়।

আলী বলেন, “আমাদের ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ ফেলে দেওয়া হয়, যেখানে কোনও খাবার, আশ্রয় বা নিরাপত্তা ছিল না। আমরা ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু বিএসএফ বলেছিল, ফিরে গেলে গুলি করা হবে।”

এরকম পরিস্থিতিতে আলীসহ কমপক্ষে ৩০০ মুসলিম নাগরিককে এইভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এই তথ্য স্বীকার করেছেন এবং এই ধরনের কার্যক্রম আরও জোরদার করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’: মানবতাবিরোধী অবস্থা

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নামে পরিচিত খোলা মাঠে ঠেলে দেওয়া এসব মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দেওয়া হয়। এখানে রাবার বুলেট ছোঁড়া হয়, গুলি ছুঁড়ে হুমকি দেওয়া হয়, আর স্থানীয় বিজিবি সদস্যদের পক্ষ থেকে কিছু সময়েই মারধর করা হয়।

রহিমা বেগম নামের এক নারী বলছেন, “আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বিজিবি মারধর করলো, আর বিএসএফ হুমকি দিলো, না গেলে গুলি করবে।”

স্থানীয় সাংবাদিক জিতেন চন্দ্র দাসের বরাত দিয়ে জানা যায়, বিএসএফ সীমান্তে চার রাউন্ড গুলি করে এই নির্বাসিত নাগরিকদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে। তবে বিএসএফ অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে তারা শুধু ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ প্রবেশ রোধ করছে।

আসামের জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতের ইতিহাস

১৮০০ সালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে আসামে চা-বাগান তৈরি হতে শুরু করে। এতে বাংলাভাষী মুসলিম ও হিন্দু শ্রমিকরা আসাম অঞ্চলে এসেছিলেন। ব্রিটিশদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে জটিল জাতিগত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

২০১৬ সালে বিজেপি সরকার আসাম রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। আসামের ৩ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি মুসলিম, যার প্রায় অধিকাংশই বাংলাভাষী। বিজেপির শাসনে এই সম্প্রদায়কে ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে নির্বাসিত করার অভিযান শুরু হয়।

নাগরিকত্ব ও এনআরসি বিতর্ক

আসামে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এনআরসি তালিকায় প্রায় ২০ লাখ নাগরিক বাদ পড়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মুসলিম। অনেকেই দাবি করেন, তাদের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ও অসংলগ্ন নথিপত্রের কারণে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে।

বিশেষ ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ কেবল একটি ছোট ভুলের জন্যই অনেককে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে, যেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আলী, সোনা বানু, খায়রুল ইসলাম, নিজাম আহমেদসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ এই বিচারের শিকার হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আদালতে আপিল করেছেন, কিন্তু অর্থের অভাবে বা রাজনৈতিক কারণে তাদের অধিকাংশ মামলার বিচার দীর্ঘসূত্রী।

সীমান্তে ঠেলে দেওয়া: মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় নীরবতা

বিভিন্ন রাজ্য থেকেও ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ সন্দেহে মুসলিম নাগরিকদের আটক ও ঠেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গসহ রাজ্যগুলোতে এই পরিস্থিতি লক্ষ্যণীয়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন ঘটনার কঠোর নিন্দা করেছেন এবং দাবি করেছেন, শুধুমাত্র বাংলাভাষী হওয়ার জন্যই তাদের ‘বাংলাদেশি’ হিসাবে গায়ে হাত উঠছে।

বিএসএফ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বেড়েই চলেছে, কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এখনও তা নিয়ে যথাযথ প্রতিকার ও তদন্ত শুরু হয়নি।

আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আসামের নাগরিকত্ব ও ‘বিদেশি’ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়ায় অনেকেই অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু মুসলিমরা লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ভারতের এই কার্যক্রমকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ এবং ‘রাষ্ট্রীয় বৈষম্য’ হিসেবে উল্লেখ করছেন।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত: এক অসহায় মানুষের গল্প

সোনা বানু বলছেন, “আমি কখনো ভাবিনি, জন্মভূমি থেকে আমার মতো মানুষকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হবে। আমি আমার দেশেই ‘বিদেশি’ হিসেবে জীবন কাটাচ্ছি।”

এমন বহু গল্প সীমান্তবর্তী এলাকায় গৃহীত হয়েছে, যেখানে মানুষ কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না পেয়ে দুই দেশের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সমাধানের পথ কী?

  • সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ: ভারত সরকারকে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে নিপীড়িত সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে হবে।
  • বৈষম্য ও ধর্মীয় ভিত্তিক অত্যাচার বন্ধ: কোনো সম্প্রদায় বা ভাষাগত গোষ্ঠীর ওপর বৈষম্য বন্ধ করতে হবে।
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও প্রতিকার: আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে নিয়ে যথাযথ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।
  • সীমান্তে নির্যাতন বন্ধ: বিএসএফ ও বিজিবির আচরণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মানবিক সহমর্মিতা বাড়ানো।
  • দ্বিপক্ষীয় আলোচনা: ভারত ও বাংলাদেশকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো সমাধানের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসতে হবে।

ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে, তা শুধুমাত্র মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, একই সঙ্গে একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত। বাংলাভাষী মুসলিমরা যাদের পূর্বপুরুষরা বহু বছর ধরে এই ভূমিতে বসবাস করে আসছেন, তাদের ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করে দেশের বাইরে ঠেলে দেওয়া তাদের জীবনের ওপর গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।

এই সমস্যা শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তাই এ বিষয়ে বিশ্ব এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো সচেতন হয়ে মানবিক সমাধানের পথে এগিয়ে আসা অপরিহার্য।

কীভাবে আপনি সাহায্য করতে পারেন?

  • মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সমর্থন করুন
  • সঠিক তথ্যের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করুন
  • সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান
  • রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নাগরিক অধিকার রক্ষার দাবি জানিয়ে প্রচারণায় অংশ নিন
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button