বাংলাদেশ

শুধু আইন প্রয়োগ করে মাদক নির্মূল সম্ভব নয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

দেশের মাদক সমস্যা শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। মাদক নির্মূলে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অতীব জরুরি। মাদক নির্মূলের জন্য সমগ্র সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে—এমন বার্তা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

তিনি বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক মাদক প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মাদক সমস্যা শুধু দেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মাদক যুবসমাজের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করছে, যা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।”

মাদকের ভয়াবহতা: যুবসমাজ ও দেশের ক্ষতি

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, মাদক শুধু একজন ব্যক্তির জীবনকে নয়, পুরো সমাজকে বিপদে ফেলে দেয়। এর ভয়াল থাবায় দেশের যুব সমাজ শৃঙ্খলহীন হয়ে পড়ছে, অর্ধেক অর্ধেক স্বপ্ন হারাচ্ছে। মাদকাসক্তির কারণে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায় পড়ে। তিনি বলেন, “মাদক চোরাচালানে শিশু ও নারীদের ব্যবহার করে অপরাধীরা সমাজকে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

সরকারী পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মাদক নির্মূলে সরকার যে বদ্ধপরিকর, তা তিনি স্পষ্ট জানান। তিনি বলেন, “আমরা উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়তে চাই। এজন্য আমাদের যুবসমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হবে। শুধুমাত্র কঠোর আইন প্রয়োগ নয়, পাশাপাশি জনসচেতনতা, শিক্ষার প্রসার, পরিবার ও সমাজের সমর্থন দরকার।”

তিনি বলেন, মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন ও সঠিক চিকিৎসার জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে আলাদা কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেখানে মাদকাসক্তরা প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে ফিরতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত: মাদক বিরোধী প্রচেষ্টা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (UNODC) মাদক নির্মূলে সচেতনতা ও সমন্বিত কর্মকাণ্ডকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মাদক সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সমন্বয় অপরিহার্য।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়, “মাদক নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদের শুধু দেশের সীমার মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করতে হবে। কারণ মাদক একটি ক্রস-বর্ডার অপরাধ, যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।”

জনসচেতনতা ও শিক্ষার গুরুত্ব

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদক নির্মূলে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো জনসচেতনতা ও শিক্ষা। পরিবার, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও কমিউনিটি লেভেলে মাদকবিরোধী কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষকে মাদক বিরোধী বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।

মাদক সমস্যার কারণে দেশে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি, অপরাধ বৃদ্ধি, পরিবারিক ভাঙন ও সামাজিক অবক্ষয়—সবই মাদকাসক্তির নেতিবাচক প্রভাব। তাই জনসাধারণের সচেতনতা বাড়ানো ছাড়াও সরকারের উচিত পুনর্বাসন কেন্দ্র, মাদকবিরোধী আইন শাস্তির পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

মাদকবিরোধী আইন ও প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী আইনগুলো অনেক শক্তিশালী হলেও সঠিক প্রয়োগ ও অনুসরণের অভাব রয়েছে। অনেক সময় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা মাদক ব্যবসাকে উদ্বুদ্ধ করে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আইনের প্রয়োগ অবশ্যই জরুরি, তবে তা একা চলবে না। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন ও সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।”

তরুণ প্রজন্মের প্রতি বার্তা

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দেশের তরুণ প্রজন্মকে সতর্ক করে বলেন, “তোমরা দেশের ভবিষ্যত। তোমাদের হাতেই দেশের ভাগ্য নির্ভর করে। মাদক থেকে দূরে থাকো, নিজের ক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে সঠিক পথে ব্যবহার করো।”

তিনি যোগ করেন, “যদি কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সাহায্য করতে হবে। মাদকাসক্তদের পাশে দাড়িয়ে তাদের পুনর্বাসনে কাজ করতে হবে, যাতে তারা সমাজে ফিরতে পারে।”

মাদক নির্মূলের জন্য কী করা যেতে পারে?

১. শিক্ষা ও সচেতনতা: স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক বিরোধী পাঠক্রম চালু করতে হবে। পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।

২. কঠোর আইন প্রয়োগ: মাদক পাচার, চোরাচালান ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কড়া আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. পুনর্বাসন কেন্দ্র বৃদ্ধি: মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য পর্যাপ্ত কেন্দ্র ও সেবা দিতে হবে।

৪. সামাজিক অংশগ্রহণ: সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে মাদক বিরোধী প্রচারণায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সীমান্ত এলাকার মাদক চোরাচালান রোধে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

মাদক সমস্যা এখন শুধু একটি অপরাধ বা স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি দেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। শুধু কঠোর আইন প্রয়োগের উপর নির্ভর করে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। দেশের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে এ যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবার, সামাজিক সচেতনতা ও শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ মাদক মুক্ত সমাজ গড়ার পথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button