ভারতীয়দের সুইস ব্যাংকে অর্থ বৃদ্ধি: কেন হঠাৎ আগ্রহ বাড়ছে?

সাম্প্রতিক সময়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতীয় নাগরিকদের অর্থ আমানতের পরিমাণ চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে। প্রশ্ন উঠছে—একসময় যেসব ব্যাংক ছিল কালো টাকার আশ্রয়স্থল হিসেবে কুখ্যাত, আজ কেন সেখানে আবার ভারতের ধনী ব্যক্তিরা অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণ। সেগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি কেবল অর্থ পাচার বা গোপন সম্পদ সংরক্ষণের চেষ্টা নয়; বরং এক জটিল অর্থনৈতিক, নীতিগত ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বাস্তবতার প্রতিফলন।
সুইস ব্যাংকে অর্থ বৃদ্ধি: পরিসংখ্যান যা বলছে
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (SNB) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতীয়দের সুইস ব্যাংকে রাখা মোট অর্থ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৯২ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। এর মধ্যে শুধুমাত্র খুচরা বা ব্যক্তিগত হিসাবের অর্থ বেড়েছে মাত্র ১১%, বাকি অর্থ এসেছে কর্পোরেট, ট্রাস্ট ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।
এই বৃদ্ধির একটা বড় অংশ এসেছে অনাবাসী ভারতীয় (NRI) ও ধনীদের কাছ থেকে, যারা বিদেশে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে নিজেদের সম্পদ আরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছেন।
মূল কারণসমূহ বিশ্লেষণ
১. আন্তর্জাতিক করনীতি ও রেগুলেশন পরিবর্তন
ইকোনমিক টাইমসের বিশ্লেষণ অনুসারে, যুক্তরাজ্য তার ২০০ বছরের পুরনো “নন-ডমিসাইল” কর সুবিধা বাতিল করেছে, যার ফলে অনেকে ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। এই ধাক্কা থেকে বাঁচতেই অনেকে সুইস ব্যাংককে বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
মইন লাধা, ভারতের আইন সংস্থা Khaitan & Co-এর অংশীদার, বলেন:
“বহু ভারতীয় পরিবার এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সুইজারল্যান্ডে বসবাসের পরিকল্পনা করছে। স্বাভাবিকভাবে তারা তাদের সম্পদও এই দেশগুলোতে সরিয়ে নিচ্ছেন।”
২. বিশ্বজুড়ে ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতা এবং চীন-আমেরিকা বাণিজ্য বিরোধের মতো ইস্যুগুলো বিশ্বব্যাপী এক অনিশ্চিত আর্থিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে নিরাপদ মুদ্রা ও স্থিতিশীল অর্থনীতির খোঁজে সুইজারল্যান্ড একটি প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
৩. সুইস ফাইনান্স সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা ও স্থিতিশীলতা
বিশ্বজুড়ে যখন মুদ্রা অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তখন সুইস ফ্রাঁ রীতিমতো শক্তিশালী। ২০২৪ সালে এই মুদ্রার মূল্য ৯.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে। জি১০ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে সুইস ফ্রাঁ।
৪. ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সম্পদ সংরক্ষণ
সুইজারল্যান্ডে ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্থ সংরক্ষণ একটি আইনসিদ্ধ ও কর-কৌশলভিত্তিক পন্থা। এতে সম্পদের প্রকৃত মালিকের নাম গোপন রেখে সম্পদ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়, যেটি ধনী পরিবারগুলো তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য করে থাকেন।
এই অর্থ কি কালো টাকা?
অনেকে ধারণা করতে পারেন, এই অর্থ কালো টাকা বা অবৈধ উপার্জন। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও পরামর্শকদের মতে, বেশিরভাগ অর্থই হলো আইনসম্মত উপার্জন, যেটি বিভিন্ন দেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ঈশা শেখরি, আন্তর্জাতিক কর-পরামর্শক, বলেন:
“অনেক সময় এই হিসাবগুলো পরিচালিত হয় বিনিয়োগ সংস্থা বা ট্রাস্টের মাধ্যমে, যার উপকারভোগী ভারতীয় হলেও তাদের নাম সরাসরি উল্লেখ থাকে না।”
এছাড়া বৈশ্বিক আর্থিক তথ্য আদান-প্রদান চুক্তির (AEOI – Automatic Exchange of Information) মাধ্যমে এখন অনেক তথ্যই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, যা আগে গোপন ছিল।
গোপনীয়তার প্রশ্নে সুইস ব্যাংক আজ কোথায়?
একসময় “সুইস ব্যাংক” শব্দটি শুনলেই গোপনীয়তার প্রতীক মনে হতো। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে।
সুইজারল্যান্ড ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন দেশের সাথে আর্থিক হিসাব বিনিময়ের চুক্তিতে সই করেছে। ফলে এখন এসব ব্যাংকে গোপনে কালো টাকা রাখার সুযোগ অনেকটাই কমে এসেছে।
তবুও, এখনও সুইস ব্যাংকগুলোতে কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, বিশেষ করে ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন বা অন্যান্য কর্পোরেট মাধ্যমে পরিচালিত হিসাবগুলোতে। অনেক ধনী পরিবার তাদের উত্তরাধিকারীর নাম সরাসরি না দিয়েও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অর্থ সংরক্ষণ করেন।
ভারতের সরকারের অবস্থান কী?
ভারতের আয়কর বিভাগ ও Enforcement Directorate (ED) বর্তমানে সুইস ব্যাংক সংক্রান্ত তথ্যগুলো খতিয়ে দেখছে। কালো টাকা ও অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করে অনাবাসী ভারতীয়দের নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
অনেক ভারতীয়কে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও করা হচ্ছে। সরকার এখন চাইছে, দেশের বাইরে গচ্ছিত সম্পদের হিসাব যেন স্বচ্ছ থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা
শুধু ভারত নয়, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে এই পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি ফ্রাঁ, অর্থাৎ ৩৩ গুণ বৃদ্ধি।
এই প্রবণতাও ইঙ্গিত দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ধনী পরিবারই নিরাপদ ও স্থিতিশীল বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে সুইস ব্যাংক বেছে নিচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ কী বলছে?
বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে সুইস ব্যাংক এখনো অনেকের কাছে এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও তথ্য বিনিময় ব্যবস্থার কারণে এ ধরনের গোপন সম্পদ রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্থপ্রবাহের পেছনে রয়েছে কর-কৌশল, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ও বিশ্বজুড়ে সম্পদ পুনর্বিন্যাসের প্রয়াস।
তবে এটি নিশ্চিত যে, সুইস ব্যাংক আর কেবল ‘কালো টাকার ঘাঁটি’ নয়—এটি হয়ে উঠছে এক আধুনিক, বৈশ্বিক আর্থিক কেন্দ্র।