যুক্তরাজ্যে গুগলের সার্চ আধিপত্যে লাগাম টানছে

যুক্তরাজ্যে গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের প্রভাব ও আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ থাকলেও এবার সরকারিভাবে তা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশটির প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা, Competition and Markets Authority (CMA)। গুগলকে ‘স্ট্র্যাটেজিক মার্কেট স্ট্যাটাস’ (Strategic Market Status – SMS) বা কৌশলগত বাজার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব আনছে সংস্থাটি, যা গৃহীত হলে গুগলের সার্চ সেবায় নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে।

গুগলের বাজার দখলের চিত্র

বর্তমানে যুক্তরাজ্যের সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটে গুগলের দখল প্রায় ৯০ শতাংশ। এ ধরনের বাজার আধিপত্য কোনো একক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকার কারণে উদ্ভাবনী উদ্যোগ, প্রতিযোগিতা ও ভোক্তার বিকল্প সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করছে CMA। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই একচেটিয়া অবস্থান একদিকে যেমন গুগলকে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় অন্যায্য সুবিধা দেয়, তেমনি সাধারণ ব্যবহারকারীদের তথ্যও গুগলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

‘স্ট্র্যাটেজিক মার্কেট স্ট্যাটাস’ কী?

CMA গুগলকে SMS মর্যাদা দিলে, এর মানে দাঁড়াবে—সার্চ মার্কেটে গুগলকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে এবং তাদের কার্যক্রমের ওপর নতুন কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে। এর মধ্যে থাকবে:

• সার্চ রেজাল্টে পক্ষপাতমূলক অ্যালগরিদম রোধ
• প্রকাশকদের কনটেন্ট প্রদর্শনে স্বচ্ছতা
• ব্যবহারকারীদের জন্য ডেটা পোর্টেবিলিটি
• অন্য সার্চ ইঞ্জিনে স্যুইচ করার সহজ উপায়

কনটেন্ট প্রকাশক ও প্রতিযোগীদের জন্য নতুন সুযোগ

CMA বলছে, গুগলের সার্চ রেজাল্টে কনটেন্ট কিভাবে র‍্যাংকিং হচ্ছে, তা আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে হবে। অনেক সময় গুগল তাদের নিজস্ব সেবাগুলোকেই সার্চ রেজাল্টে এগিয়ে রাখে। এটি অন্যান্য ওয়েবসাইট বা নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য একপ্রকার অবিচার। নতুন নীতিমালায় এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব ঠেকানো হবে।

তাছাড়া প্রকাশক বা কনটেন্ট নির্মাতারা যাতে নিজের কনটেন্টের কিভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেদিকে CMA বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

ডেটা পোর্টেবিলিটি: ব্যবহারকারীর অধিকার নিশ্চিত করা

ডেটা পোর্টেবিলিটি হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ব্যবহারকারী চাইলে নিজের সার্চ হিস্টোরি, সেটিংস, ও অন্যান্য তথ্য অন্য সার্ভিসে স্থানান্তর করতে পারবেন। ফলে একটি প্ল্যাটফর্মে আটকে না থেকে, তারা সহজেই প্রতিযোগী প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারবেন। CMA চাচ্ছে এই ফিচারটি বাধ্যতামূলক করা হোক, যাতে উদ্ভাবনী স্টার্টআপ ও প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকে থাকতে পারে।

CMA প্রধানের বক্তব্য

CMA’র CEO সারাহ কার্ডেল জানিয়েছেন, “গুগল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। তারা বহু সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু তাদের একচেটিয়া অবস্থান যুক্তরাজ্যের ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের বিকল্প ও উদ্ভাবন থেকে বঞ্চিত করছে। আমাদের নতুন নিয়মাবলির মাধ্যমে ন্যায্য প্রতিযোগিতা ও ব্যবহারকারীর অধিকার নিশ্চিত হবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা চাচ্ছি প্রযুক্তি খাতে উদ্ভাবনের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে। এটি শুধু গুগল নয়, সকল বৃহৎ ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই স্পষ্ট বার্তা।”

গুগলের প্রতিক্রিয়া: CMA’র প্রস্তাবে অস্বস্তি

গুগল CMA’র এই সিদ্ধান্তে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। গুগলের প্রতিযোগিতা বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর অলিভার বেথেল বলেছেন, “আমরা উদ্বিগ্ন যে CMA একতরফাভাবে, যথাযথ বিশ্লেষণ ও প্রমাণ ছাড়াই এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসায়ি ও ব্যবহারকারী—দু’পক্ষই।”

তিনি বলেন, “আমরা সবসময় প্রতিযোগিতার পক্ষে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের উন্নত প্রযুক্তি ও সুবিধাগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: দীর্ঘমেয়াদে আরও বড় পরিবর্তন

CMA জানিয়েছে, এই উদ্যোগ কেবল শুরু। ২০২৬ সাল থেকে সার্চ বিজ্ঞাপন বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এটি Google Ads, YouTube Ads, ও Display Networks-এর ওপর প্রভাব ফেলবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও চাপ বাড়ছে

শুধু যুক্তরাজ্যই নয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশেই গুগলের বাজার আধিপত্য নিয়ে তদন্ত চলছে। ইউরোপে Google Shopping ও Android অপারেটিং সিস্টেমের বিরুদ্ধে আগে থেকেই বেশ কয়েকটি জরিমানা কার্যকর হয়েছে।

২০২৪ সালের শেষ দিকে ইউরোপিয়ান কমিশন গুগলের বিরুদ্ধে $২.৮ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রেও গুগলের বিরুদ্ধে একাধিক অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা চলমান রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতামত

ডিজিটাল মার্কেট বিশ্লেষক হেনরি ব্রুকস বলেন, “CMA-এর পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। গুগলের সার্চ অ্যালগরিদমের জটিলতা এবং এর অপারগ ব্যবহার বহু প্রতিষ্ঠানকে বাজার থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রতিষ্ঠান ও উদ্ভাবনকে জায়গা করে দেওয়ার।”

সম্ভাব্য প্রভাব

এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে গুগলের সার্চ সেবা ব্যবহারে সাধারণ ব্যবহারকারীরা অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ পাবেন। ওয়েবসাইট মালিক ও ব্যবসায়িরা আরও ন্যায্য প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবেন। ফলে প্রযুক্তি বাজারে স্বচ্ছতা, উদ্ভাবন ও বিকল্প পরিষেবার প্রসার ঘটবে।