ফ্যাক্ট চেক

ইসলাম সহজ ও সুন্দর — মধ্যপন্থার শিক্ষা

ইসলাম সহজ, কঠিন করবেন না — নবীজির (সা.) মধ্যপন্থার শিক্ষা ও জীবন দর্শন

ইসলাম ধর্মের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যপন্থা বা ওসাত বোধ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে স্পষ্টভাবে বলেন, “আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।” (সূরা বাকারা, আয়াত ১৪৩) এই আয়াতের মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে ন্যায়পরায়ণ, সঠিক, পরিমিত ও শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।ইসলাম সহজ ও সুন্দর — কঠোরতা নয়, মধ্যপন্থা মেনে চলাই উত্তম

আরবি শব্দ ‘ওসাত’ মানে হলো পরিমিতি, সঠিক, ন্যায়পরায়ণতা এবং মধ্যপন্থা। ইসলামে এটি মানে কঠোরতা বা অতিরিক্ত কঠিন বিধানের কোনো স্থান নেই। বরং এটি এমন একটি জীবনপন্থা যা মানুষের সক্ষমতা ও সামর্থ্যের মধ্যে থেকে পালনীয়। তাই ইসলামকে কখনোই কঠিন বা জটিল ভাবা উচিত নয়।

নবীজির (সা.) জীবন থেকে সহজ ও মাঝারি পথের শিক্ষা

একদিন নবীজির (সা.) স্ত্রীর কাছে তিনজন ব্যক্তি এসেছিলেন, যারা নিজেদের ইবাদত সম্পর্কে বলছিলেন। কেউ রাতে সারারাত নামাজ পড়বেন, কেউ দিনের পর দিন রোজা রাখবেন আবার কেউ বিয়েও করবেন না। এসময় নবীজির (সা.) বললেন,
“আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের মধ্যে আমি তাঁকে সবচেয়ে ভালো জানি; আমি প্রতিদিন রোজা রাখি না, রাতভর নামাজ পড়ি না এবং আমি স্ত্রীসঙ্গ গ্রহণ করি; যে আমার পথ অনুসরণ করতে চায় না, সে আমার দলভুক্ত নয়।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৬৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪০১)

এখানে নবীজি (সা.) স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে ধর্মে অতিরিক্ত কঠোরতা গ্রহণ করা উচিত নয়। তাঁর জীবনেই রয়েছে পরিমিতি, সহজ ও মধ্যপন্থার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

ইসলামে মধ্যপন্থার গুরুত্ব ও তার সুফল

নবীজি (সা.) সাহাবিদের মধ্যে সর্বদা পরিমিতি ও সহজপন্থা প্রচলন করতেন। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হতো, তিনি সবসময় সহজতম উপায় বেছে নিতেন, যতক্ষণ না তা ইসলামের মূলনীতির বিরোধী হত। তিনি বলেছিলেন,
“নিশ্চয়ই এই দীন সহজ। কেউ এই দীনের সঙ্গে কঠোরতা করতে চাইলে, তা তাকে পরাভূত করবে। অতএব তোমরা সঠিক পথে থাকো, মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, আনন্দিত হও এবং সকাল-সন্ধ্যার কাজে ও রাতের কিছু অংশে (ইবাদতের মাধ্যমে) সাহায্য প্রার্থনা করো।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮১৬)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়:

  • ইসলামের সহজ প্রকৃতি: ইসলাম মানুষের জন্য সহজ ও গ্রহণযোগ্য। এটি এমন কোনো বিধান দেয় না যা পালন করা অসম্ভব বা অতিরিক্ত কষ্টকর।
  • কঠোরতার পরিণাম: ধর্মীয় দায়িত্ব অতিরিক্ত কঠিন করলে ব্যক্তি ক্লান্ত ও হতাশ হয়। ফলে সে তার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারে।
  • মধ্যপন্থার অনুশীলন: নিজের সামর্থ্যের মধ্যে থেকে নিয়মিত আমল করা। ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করা।
  • আনন্দ ও ইতিবাচকতা: আল্লাহর রহমত নিয়ে আশাবাদী থাকা এবং আনন্দিত জীবন যাপন করা।
  • নিয়মিত ইবাদতের গুরুত্ব: সকাল, সন্ধ্যা ও রাতের ইবাদত জীবনের নিয়মিত অংশ হিসেবে গ্রহণ করা।

পরিমিতি ও ধারাবাহিকতা — ইসলামের মূলমন্ত্র

মধ্যপন্থা মানে হলো পরিমিতি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিমদের ওপর আরোপিত দৈনন্দিন দায়িত্বগুলো যেমন — নামাজ পড়া, আল্লাহর একত্ব বিশ্বাস, তার স্মরণ, অন্যদের প্রতি সদয় আচরণ ইত্যাদি — এগুলো অত্যন্ত সহজ ও গ্রহণযোগ্য। এছাড়া বার্ষিক রোজা ও অন্যান্য ফারজ ইবাদত পালন করাই যথেষ্ট।

যখন কেউ অতিরিক্ত কঠোরতা বা অতিরিক্ত ইবাদত করতে চায়, তখন নবীজির (সা.) এই নির্দেশ মেনে চলা জরুরি:
“কোনো ব্যক্তি শুধু তার ভালো কাজের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, “এমনকি আপনি (নবীজি)ও নয়?” তিনি উত্তর দিলেন, “এমনকি আমিও না, যদি না আল্লাহ তাঁর দয়া ও রহমত আমাকে দান করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৬৭)

এখান থেকেই বোঝা যায়, শুধু আমল নয়, আল্লাহর দয়া ও রহমত ছাড়া জান্নাত লাভ অসম্ভব।

নিয়মিততা ও সামর্থ্যের বাইরে যাবেন না

আমাদের পবিত্র নবী (সা.) আয়েশা (রা.) কে বলেছেন,
“যে কাজগুলো নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে করা হয়, এমনকি যদি তা একটু কমও হয়, সেগুলো আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৬৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৮২)

এবং তিনি আরও বলেন,
“তুমি যা পারো তা করো।”
অর্থাৎ, নিজের সামর্থ্যের মধ্যে থেকে কাজ করুন। নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপাবেন না, কারণ এটি ইসলাম ও নবীজির শিক্ষা বিরোধী।

ইসলাম মানেই ভালোবাসা ও সহজপন্থা

সর্বশেষ নবীজি (সা.) বলেছিলেন,
“ভালো কাজগুলো সঠিকভাবে, সৎভাবে এবং পরিমিতভাবে করো। সব সময় একটি মাঝারি, পরিমিত, নিয়মিত পথ গ্রহণ করো, যাতে তুমি তোমার লক্ষ্য (জান্নাত) অর্জন করতে পারো।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৬৭)

অর্থাৎ, ইসলাম কঠিন বা জটিল কোনো পথ নয়। এটি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থেকে পালনীয় সহজ, সুন্দর ও পরিমিত জীবন।

ইসলাম শিক্ষা দেয় মধ্যপন্থা, সহজতা, পরিমিতি এবং ধারাবাহিকতায়। নবীজির (সা.) জীবন ও হাদিসসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, অতিরিক্ত কঠোরতা বা জটিলতা ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। একজন মুসলিমকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ইবাদত ও অন্য দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সে আনন্দের সঙ্গে আল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রকাশ করতে পারে। অতিরিক্ত কঠোরতা কেবল ক্লান্তি ও হতাশার কারণ হয়।

তাই ইসলামকে সহজ ও সুন্দর মনে করুন, কঠিন করবেন না। নবীজির (সা.) মাধ্যমেই শেখা উচিত জীবন পরিচালনার এই পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ পথ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button