ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে বিশ্ব বাজারে সোনার দামও কমেছে

ইরান ও ইসরায়েলের দীর্ঘ ১২ দিনব্যাপী সংঘাত শেষ হয়ে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর বিশ্ব বাজারে তেলের পাশাপাশি সোনার দামেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার সময় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার দাম বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ সময়টা ছিল ব্যতিক্রম—সোনার মূল্য বিশ্ব বাজারে কমে গেছে, যা বেশ অবাক করার মতো বিষয়।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ও সোনার দামের পরিবর্তন
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে স্পট সোনার দাম আউন্সপ্রতি প্রায় ১.৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩,৩১৯.৯৬ মার্কিন ডলার। এমনকি এক সময় দামের পতন ২ শতাংশেরও বেশি হয়েছে। এটি ৯ জুনের পর থেকে সবচেয়ে নিচের অবস্থান। একই সঙ্গে মার্কিন গোল্ড ফিউচারসের দামও ১.৮ শতাংশ কমে ৩,৩৩৩.৯ ডলারে নেমে এসেছে।
বিশ্ববাজারে এ রকম দাম কমার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা উল্লেখ করছেন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমে যাওয়া। যুদ্ধবিরতির ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। ফলে সোনার চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম হ্রাস পেয়েছে।
সাধারণত যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় সোনা কেন দাম বাড়ে?
সোনা বিশ্বব্যাপী নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কমাতে সোনায় বিনিয়োগ বাড়ান। এ কারণে যুদ্ধকালীন সময়ে বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় সোনার দাম সাধারণত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক সংঘাত ও যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতিতে বাজারের বিভিন্ন দিক পরিবর্তিত হয়েছে।
বিশ্ববাজারের সামগ্রিক প্রভাব
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। মার্কিন ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য উভয় পক্ষকে দোষারোপ করেছেন, যা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করলেও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের নীতি ও সোনার দাম
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সম্প্রতি কংগ্রেসে বলেছেন, আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক মূল্যস্ফীতিতে কী প্রভাব ফেলছে, তা বুঝতে সময় লাগবে। এর পরই মার্কিন নীতি সুদহার কমানো হতে পারে। সাধারণত মার্কিন নীতি সুদ কমলে সোনার দাম বাড়ে, কারণ সোনা থেকে সরাসরি সুদ পাওয়া যায় না। বর্তমানে বিশ্লেষকরা আশাবাদী, চলতি বছরের শেষে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট সুদ কমতে পারে, যা অক্টোবরেই শুরু হতে পারে।
অন্যান্য ধাতুর বাজারের অবস্থান
সোনার পাশাপাশি রুপার দামও হ্রাস পেয়েছে। গতকাল রুপার দাম আউন্সপ্রতি প্রায় ০.৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৮৩ ডলারে, যা ৫ জুনের পর সর্বনিম্ন। অন্যদিকে প্লাটিনামের দাম বেড়ে ১,৩১৪.৯১ ডলারে পৌঁছেছে, কিন্তু প্যালাডিয়ামের দাম কমে আউন্সপ্রতি ১,০৬১.৯০ ডলারে নেমে এসেছে।
দেশের বাজারে সোনার দাম ও প্রভাব
বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে সোনার দামও পরিবর্তিত হয়েছে। গতকাল সোনা ব্যবসায়ীরা ভরিতে সর্বোচ্চ ১,৬৬৮ টাকা পর্যন্ত দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যার ফলে ২২ ক্যারেটের সোনার প্রতি ভরির দাম কমে দাঁড়াবে ১,৭২,৮৬০ টাকা। নতুন দাম আজ থেকে কার্যকর।
সোনার ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন ও বিনিয়োগ পরামর্শ
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৩০০ ডলারের কাছাকাছি থাকাটা ভালো এবং এই দামে বেচাকেনা বৃদ্ধি পাবে। যদি দাম আরও নেমে আউন্সপ্রতি ৩,২৫০ ডলারে পৌঁছায়, তাহলে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য আরেকটু আকর্ষণীয় হবে। এখন সময়, যারা সোনায় বিনিয়োগ করতে চান তাদের জন্য অপেক্ষা ও মনিটরিং করার।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সোনার বাজার
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা তেলসহ অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি প্রক্রিয়া উন্নয়নের প্রভাব সোনার মতো মূল্যবান ধাতুর বাজারেও স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে।
নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য সোনার গুরুত্ব
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়ার সময় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনা অন্যতম প্রধান সম্পদ। তবে সোনার বাজারের ওঠানামা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অর্থনৈতিক নীতি ও বৈশ্বিক চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সোনার চাহিদা কমতে পারে, আর এতে দামও পতিত হবে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রভাব বিশ্ব বাজারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানে তেলের পাশাপাশি সোনার দামেও পতন দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গেই সোনার বাজারের ওঠানামা যুক্ত থাকায় বিনিয়োগকারীদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৩০০-৩,২৫০ ডলারের মধ্যে থাকা একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি করছে।