নতুন দামে পেঁয়াজের বাজারে নাটকীয় পতন, মণপ্রতি ২০০ টাকা কমেছে

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদন এলাকা ফরিদপুরে পেঁয়াজের বাজারে হঠাৎ করেই ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ঠেনঠেনিয়া বাজারে গত দুই দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রতি মণ প্রায় ২০০ টাকা কমে এখন ১,৫৫০ থেকে ১,৬৫০ টাকা পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই দামপতনের প্রভাবে স্থানীয় পেঁয়াজ চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
পেঁয়াজের দাম কমার পেছনে কারসাজি?
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই দরপতনের কারণ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। পেঁয়াজ চাষিরা অভিযোগ করছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে পেঁয়াজের দাম জনিত সংকট সৃষ্টি করেছেন। তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে যাচ্ছে, যা তাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
অন্যদিকে, পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, সাম্প্রতিক ঈদের পর থেকে বিদেশ থেকে পেঁয়াজের আমদানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমেছে। ফলে তারা বলছেন, বাজারের দাম স্বাভাবিকেই নিচে নামছে।
ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দা অঞ্চলে পেঁয়াজ উৎপাদন
ফরিদপুর জেলা দেশের অন্যতম প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদন কেন্দ্র। সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের খোয়াড় গ্রামের পেঁয়াজ চাষি দেলোয়ার মাতুব্বর জানান, “গত রবিবার সকালে আমি ঠেনঠেনিয়া বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। ভোর ছয়টায় বাজারে গিয়ে দেখলাম অধিকাংশ ব্যবসায়ীর দোকান বন্ধ। পরে শত শত চাষি পেঁয়াজ নিয়ে আসেন, তবে ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় একযোগে দাম কমিয়ে দিয়েছেন।”
ঠেনঠেনিয়া বাজার: দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজ হাট
সালথার ঠেনঠেনিয়া বাজার দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজ বাজারগুলোর মধ্যে একটি। প্রতি সপ্তাহে রবিবার ও বুধবার এই বাজার বসে। এক একদিনে এখানে দুই শতাধিক বড় ব্যবসায়ী প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টন পেঁয়াজ কেনা-বেচা করেন। পেঁয়াজগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে রপ্তানি হয়।
পেঁয়াজ চাষির দুঃখ-দুর্দশা
অন্যদিকে, পেঁয়াজ চাষিরা জানান, পেঁয়াজ চাষে খরচ দিনদিন বাড়ছে, কিন্তু বাজারে দাম তার তুলনায় বাড়ছে না। ঠেনঠেনিয়ার একজন পেঁয়াজ চাষি নিজাম উদ্দিন শেখ বলেন, “পেঁয়াজ যখন জমি থেকে উঠেছে, সেই সময় দাম ছিল প্রায় ১,০০০ টাকা প্রতি মণ। এরপর ভাল দাম পাওয়ার আশায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছিলাম, কিন্তু এখন যে দাম, তাতে পুঁজি ফিরানো কঠিন।”
আরেক চাষি ইব্রাহিম মাতুব্বর (৫২) দাবি করেন, “যদি প্রতি মণ পেঁয়াজ ২,০০০ থেকে ২,২০০ টাকায় বিক্রি হত, তাহলে লোকসান হতো না। কিন্তু এই দামেই আমরা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।”
ফরিদপুরে পেঁয়াজের আবাদ ও উৎপাদন: পরিসংখ্যান
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহেদুজ্জামান জানান, ফরিদপুরে প্রধানত তিন প্রকার পেঁয়াজের আবাদ হয়—মুড়িকাটা, হালি এবং দানা পেঁয়াজ। এর মধ্যে হালি পেঁয়াজের আবাদ সবচেয়ে বেশি। চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে ফরিদপুরে ৪৩,২৬০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৬,৭৬,৯১৮ মেট্রিক টন।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ঠেনঠেনিয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদের পর পেঁয়াজের সরবরাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা কমে গেছে। তবে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম পুনরায় সমন্বয় ঘটবে।
জেলা জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেন বলেন, “কৃষিপণ্যের দাম অনেক সময় ওঠানামা করে। বৃষ্টি এবং সরবরাহ বৃদ্ধি দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। তবে এই দামপতন স্থায়ী হবে না, দাম আবার বাড়বে। কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
পেঁয়াজের বাজারে দাম কমার পরিণতি ও সম্ভাবনা
পেঁয়াজ দেশের রান্নার অন্যতম প্রধান উপকরণ, যার দরকার সর্বত্র ব্যাপক। পেঁয়াজের দাম যখন বেশি থাকে, তখন সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়ে, আবার দাম কমে গেলে কৃষকেরা আর্থিক সংকটে পড়েন। তাই পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরিদপুরের এই বাজার দরপতনের ঘটনা কৃষকদের জন্য মারাত্মক ধাক্কা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত বাজারে সিন্ডিকেটের অভিযোগের তদন্ত করা এবং কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। পাশাপাশি পেঁয়াজ আমদানি ও রপ্তানি নীতিমালা আরও সুষম করতে হবে যাতে দেশীয় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে করণীয় পদক্ষেপ
- সিন্ডিকেট বিরোধী অভিযান: সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
- কৃষক সুরক্ষা: চাষিরা যাতে লাভবান হন তার জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা।
- সরকারি হস্তক্ষেপ: বাজারে অতিরিক্ত পেঁয়াজ আসার সময় দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
- সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ: পেঁয়াজ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অতিরিক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা।
- তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার: বাজারের তথ্য সরবরাহে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বচ্ছতা আনা।
ফরিদপুরের ঠেনঠেনিয়া পেঁয়াজ বাজারের এই দরপতন দেশের পেঁয়াজ চাষ ও বিপণন খাতে এক বড় সংকেত। সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চাষিরা আর্থিক সংকটে পড়বেন, আর বাজারে পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে না। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বাজারের সুস্থতা নিশ্চিত করতে।