বিশ্ব

গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সকে ১৬০ কোটি ডলার দেবে গেটস ফাউন্ডেশন

বিশ্বের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিশুদের মধ্যে টিকা পৌঁছে দিতে সহায়তা করে এমন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স’-কে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ১৬০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। মঙ্গলবার (২৪ জুন) এই ঘোষণা দিয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে নতুন মাত্রা যুক্ত করলো বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দাতব্য সংস্থাটি।

বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ও ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এক বিবৃতিতে জানান, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে অনেক উন্নয়নশীল দেশে টিকা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে এবং শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় গ্যাভিকে শক্তিশালী অর্থায়ন প্রদানই এখন সর্বোত্তম পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তিনি।

গ্যাভির জন্য ব্যাপক তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য

২০২৬ সাল থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়কালের জন্য গ্যাভির লক্ষ্য হচ্ছে ৯০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি অর্জন করা। এই বিশাল তহবিলের মাধ্যমে তারা বিশ্বের অন্তত ৮৬টি দরিদ্র দেশের শিশু ও মা-বাবাদের মধ্যে টিকা পৌঁছে দিতে চায়। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই অর্থায়নের মাধ্যমে তারা আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টিকার ডোজ সরবরাহ করতে পারবে। এতে রক্ষা পাবে কোটি কোটি শিশু এবং প্রতিরোধ করা যাবে ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, হাম ও পোলিওর মতো প্রাণঘাতী রোগ।

এই লক্ষ্যে গ্যাভি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি সম্মেলনের আয়োজন করছে আগামীকাল (২৬ জুন) বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গেটস ফাউন্ডেশন এই সম্মেলনের যৌথ আয়োজক। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি দাতা সংস্থা ও করপোরেট অংশীদারদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এই সম্মেলনের মাধ্যমেই গ্যাভি তার লক্ষ্যমাত্রার একটি বড় অংশ সংগ্রহ করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন হ্রাসের আশঙ্কা

এদিকে গ্যাভির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সাধারণত প্রতি বছর গ্যাভিকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই অর্থায়ন বাতিল বা কমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।

এই অর্থায়ন কমে গেলে গ্যাভির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলেই আশঙ্কা করছেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী সানিয়া নিশতার। তিনি জানান, যদি যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে অতিরিক্ত অন্তত ১২ লাখ শিশু প্রাণ হারাতে পারে। তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি যেখানে টিকা সহজলভ্য থাকা সত্ত্বেও অনুদান সংকটের কারণে শিশুদের মৃত্যু মেনে নেওয়া অনুচিত।”

গ্যাভির কার্যক্রম এবং প্রভাব

২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া গ্যাভি একটি বৈশ্বিক অংশীদারত্বমূলক সংস্থা যা বিশ্বব্যাপী দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের টিকা দিতে সাহায্য করে। গ্যাভি সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ সংস্থা এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাথে সমন্বয় করে কাজ করে থাকে। এ পর্যন্ত গ্যাভির উদ্যোগে ১১০ কোটির বেশি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে এবং আনুমানিক দুই কোটির বেশি প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় যে মডেল ব্যবহার করে, সেটি উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ। সাধারণত গ্যাভি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে দেশের সরকারকে টিকা কেনার জন্য অর্থায়ন দেয়। এরপর দেশটি ধীরে ধীরে নিজস্ব তহবিল থেকে টিকা কেনার সক্ষমতা অর্জন করে। এভাবে গ্যাভি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়ায়, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে দেশগুলোর স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করে।

টিকা কর্মসূচির গুরুত্ব

বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকাদান কর্মসূচি হলো জনস্বাস্থ্যের অন্যতম সফল হস্তক্ষেপ। শিশুর প্রথম পাঁচ বছর হলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময়েই টিকা দিয়ে শিশুকে অনেক রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সঠিক সময়ে টিকা দেওয়া হলে প্রতিবারের ১ ডলারের বিনিময়ে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিকভাবে ২৬ ডলারের সমপরিমাণ সুফল পাওয়া যায়।

গেটস ফাউন্ডেশনের দেওয়া অর্থায়নের ফলে এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত হবে এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলগুলোতে জীবন বাঁচানোর একটি বড় সুযোগ তৈরি হবে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে এই অর্থায়ন একটি জীবনরক্ষাকারী উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাস্থ্যখাতের অনুদানকে সংকুচিত করছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্যাভির মতো সংস্থাগুলোর প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গেটস ফাউন্ডেশনের মতো বড় সংস্থাগুলোর নেতৃত্ব গ্যাভির জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাদান কর্মসূচি টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু অনুদানের ওপর নির্ভর না করে স্বনির্ভরতা বাড়ানো, জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের দিকেও নজর দিতে হবে।

উপসংহার

গেটস ফাউন্ডেশনের এই ১৬০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি শুধু আর্থিক অনুদান নয়, এটি একটি মানবিক অঙ্গীকার। বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও যেন একটি সুস্থ জীবন লাভ করে, সেটি নিশ্চিত করতে এই অর্থ সহায়তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এখন প্রয়োজন গ্যাভির পাশে দাঁড়ানোর মতো আরও অনেকের অগ্রণী ভূমিকা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি রোগমুক্ত পৃথিবী পায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button