সংঘাতের শেষ দিনে প্রথমবারের মতো প্রাণ গেল ইসরায়েলি সেনার

ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্বে টানা ১২ দিনের সামরিক উত্তেজনা শেষে যুদ্ধবিরতির প্রাক্কালে প্রথমবারের মতো একজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হওয়ার খবর জানাল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন কর্পোরাল এইটান জ্যাকস নামের ১৮ বছর বয়সী এক সেনা সদস্য, যিনি বিয়ারশেবা অঞ্চলে মাল্টিডোমেন ইউনিটের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন।
যুদ্ধবিরতির প্রাক্কালে প্রাণঘাতী হামলা
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকালে ইরানের ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিয়ারশেবা অঞ্চলে আঘাত হানে। এই হামলায় জ্যাকস নিহত হন তার পরিবারের আরও দুই সদস্যসহ নিজ বাড়িতে। একই ঘটনায় পাশের একটি অ্যাপার্টমেন্টে আরও একজন নিহত হন বলে আইডিএফ জানায়। ইসরায়েলি বাহিনীর ভাষ্যমতে, এই হামলা যুদ্ধবিরতির ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তে সংঘটিত হয় এবং তারা এটিকে একটি ‘নিষ্ঠুর ও চুক্তি লঙ্ঘনকারী কাজ’ হিসেবে আখ্যা দেয়।
তবে তেহরান ভিন্নমত পোষণ করেছে। ইরানের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক কার্যকারিতা শুরুর আগেই তারা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে এবং এটি পূর্ব-নির্ধারিত প্রতিরক্ষা পদক্ষেপের অংশ ছিল।
ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া ও বার্তা
আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কর্পোরাল জ্যাকসের মৃত্যু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য এক গভীর শোকের বিষয়। তাঁকে সম্মান জানাতে বিশেষ সামরিক আনুষ্ঠানিকতা আয়োজন করা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক শোকবার্তায় বলেন, “এই সংঘাত আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, এবং জ্যাকসের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সংঘাত চলাকালে ইরানের হামলার জবাবে শতাধিক পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। তবে, বিয়ারশেবার ঘটনাটি বিশেষভাবে বেদনাদায়ক কারণ এটি যুদ্ধবিরতির সময়েও সংঘটিত হয়েছে।
১২ দিনের সংঘাতে ২৮ জন নিহত
১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া এই দ্বিপাক্ষিক সংঘাতে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল জানিয়েছে, ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে জ্যাকস ব্যতীত বাকি ২৭ জনই বেসামরিক নাগরিক। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ড্রোন হামলা এবং বিভিন্ন ধরণের প্রতিরোধমূলক অভিযানে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে, তেহরান কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নিহতের সংখ্যা নিয়ে এখনো ভিন্ন তথ্য প্রদান করছে।
হামলার প্রকৃতি ও কৌশলগত বিশ্লেষণ
সাম্প্রতিক এই হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছিল ‘জুলফিকার’ ও ‘খোরামশাহর’ ধরনের, যেগুলো দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইরান এই হামলার সময় ইলেকট্রনিক জ্যামিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, ইরান কৌশলগতভাবে বিয়ারশেবাকে লক্ষ্য করেছিল, কারণ এখানে একাধিক সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও লজিস্টিক হাব রয়েছে। এ ছাড়া, এই অঞ্চলটি প্রতিরক্ষার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে স্পর্শকাতর।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বিবৃতিতে বলেন, “এই সংঘাত আর দীর্ঘায়িত করা উচিত নয়। সময় এসেছে গাজা ও সমগ্র অঞ্চলে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার।” মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আরেকটি মৃত্যু নয়, শান্তিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এই মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং বলেন, “এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগেই একটি তরুণ সেনা প্রাণ হারানো মানবিক ট্র্যাজেডি।”
ইরান কী বলছে?
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলার দায় অস্বীকার না করলেও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির আগেই আমাদের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে, তাই আমরা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছি।”
তেহরান আরও জানায়, তারা সংঘাতকে আর বাড়াতে চায় না এবং একটি টেকসই সমাধানের জন্য কূটনৈতিক আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখতে আগ্রহী।
কর্পোরাল এইটান জ্যাকস: একটি প্রতীক
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া কর্পোরাল এইটান জ্যাকসকে অনেকেই ‘নতুন প্রজন্মের প্রতিরক্ষা প্রতীক’ হিসেবে দেখছেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়িতে অবস্থানকালেই তার মৃত্যু হয়, যা একটি অসহনীয় ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে হাজারো মানুষ জ্যাকসের আত্মার শান্তি কামনা করে বার্তা দিয়েছেন। আইডিএফ এক টুইটে লিখেছে, “এইটান শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিজ্ঞার প্রতিচ্ছবি।”
যুদ্ধবিরতির পরবর্তী পদক্ষেপ
বর্তমানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে, তবে ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকি এখনো থেকে যাচ্ছে। উভয় দেশই সামরিক প্রস্তুতি ধরে রেখেছে এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই সংঘাতের শেষ দিনে একজন সেনার মৃত্যু কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং এটি যুদ্ধের জটিল বাস্তবতার প্রতিফলন
ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের শেষ দিনে কর্পোরাল এইটান জ্যাকসের মৃত্যু যেন পুরো সংঘাতের হৃদয়বিদারক প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এমন প্রাণহানি স্মরণ করিয়ে দেয়, কোনো সামরিক সমাধান স্থায়ী শান্তির বিকল্প হতে পারে না। এই মৃত্যু হতে পারে দুই দেশের জন্যই সংযম, সংলাপ ও শান্তির নতুন যাত্রার অনুপ্রেরণা।