বিশ্ব

কাতারে ইরানের হামলার শিকার মার্কিন ঘাঁটি আল উদেইদে আসলে কী আছে

২৪ জুন ২০২৫, মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি আল উদেইদে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই হামলা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার নতুন ধাপ। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়তি আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলার পর তাদের ঘাঁটিগুলোও লক্ষ্য করা হবে। এই প্রতিবেদনটিতে আল উদেইদ ঘাঁটির গুরুত্ব, ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং সাম্প্রতিক হামলার প্রভাব বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।

আল উদেইদ সামরিক ঘাঁটির গুরুত্ব

কাতারের রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির বিস্তৃত এলাকায় অবস্থিত আল উদেইদ বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। এটি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের অগ্রবর্তী সদর দফতর হিসেবে কাজ করে।

এই ঘাঁটিটি কাতারের নিজস্ব বিমানবাহিনী ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং আরও কয়েকটি দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আস্থাস্থল। এখানে প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে।

আল উদেইদ ঘাঁটিতে কী রয়েছে?

১. ব্যাপক অবকাঠামো:
২৪ হেক্টরের এই ঘাঁটিতে দীর্ঘ রানওয়ে, আধুনিক টার্মিনাল, রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরণের সামরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামো রয়েছে।

২. সামরিক ক্ষমতা:
উড়োজাহাজের জন্য উন্নত রানওয়ে থাকার কারণে দ্রুত বিমান পরিচালনা সম্ভব। হেরকিউলিস সি-১৩০ কার্গো বিমান, গোয়েন্দা বিমান ও স্টেলথ বিমানসহ শতাধিক সামরিক বিমান এখানে স্থায়ীভাবে বা প্রয়োজন অনুযায়ী অবস্থান নিতে পারে।

৩. কৌশলগত অবস্থান:
মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে হওয়ায় ইরাক থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম চালানো হয় এখান থেকে।

৪. অর্থনৈতিক দিক:
কাতারের প্রায় ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ঘাঁটির অবকাঠামো উন্নত করা হয়েছে, যা মার্কিন সামরিক প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. মানবিক ও সামরিক অভিযানে ভূমিকা:
আল উদেইদ ঘাঁটি ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান, বিশেষ করে ২০২১ সালে কাবুল থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার কাজে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপট ও কারণ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ায় তেহরান পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। গতকাল, ২৩ জুন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়তি ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে প্রতিহিংসামূলক হামলা হবে।

এরই ফলস্বরূপ রাতে দোহায় অবস্থিত আল উদেইদ ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। কাতারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিহত করেছে এবং অনেক ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।

আল উদেইদ কি হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল?

যুক্তরাষ্ট্র আগেই সতর্ক অবস্থানে ছিল বলে জানা গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সম্ভাব্য বিস্তারের আগে স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ঘাঁটির বিমান সরিয়ে নিয়েছিলেন।

৫ ও ১৯ জুনের মধ্যে স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা গেছে, ঘাঁটির রানওয়ে থেকে বেশ কয়েকটি সামরিক বিমান সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যা নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাহরাইনের বন্দর থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

হামলার প্রভাব ও কাতারের প্রতিক্রিয়া

কাতার সরকার এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং এটিকে তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুতর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, “এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।”

তবে কাতার-ইরান দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কাতার একই সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলারও নিন্দা জানিয়ে আসছে।

মার্কিন সামরিক অপারেশনে আল উদেইদের ভূমিকা

গত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার সময় আল উদেইদ ঘাঁটি সরাসরি যুক্ত ছিল না। হামলার জন্য বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের হুইটম্যান বিমানঘাঁটি থেকে ইরানের দিকে যাত্রা করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ঘাঁটি এই অভিযানে ব্যবহৃত হয়নি।

ভবিষ্যত প্রভাব ও বিশ্লেষণ

আল উদেইদ ঘাঁটির ওপর হামলা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ও কৌশলগত পরিকল্পনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এই হামলা তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়াবে এবং অঞ্চলটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি সংকটময় করে তুলবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাতারের ভূখণ্ড ব্যবহার করে মার্কিন সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি, ইরানের এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, তারা তাদের প্রতিক্রিয়া দ্রুত এবং কঠোর হতে পারে।

  • আল উদেইদ ঘাঁটি কাতারের মরুভূমিতে অবস্থিত, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি।
  • ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তেহরান ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের নতুন সংকটের সূচনা করেছে।
  • ঘাঁটিতে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক অবকাঠামো এবং হাজার হাজার সেনা অবস্থান করে।
  • হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক ছিল এবং নিরাপত্তার জন্য বিমান সরিয়ে নিয়েছিল।
  • কাতার এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
  • ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক: এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

কাতার মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী। তবে কাতার ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই সংযোগ সামরিক সংঘাতকে আরো জটিল করে তোলে। আল উদেইদ ঘাঁটির ওপর হামলা কাতারের ভূমিকার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে পারে, যেখানে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button