বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে লুটপাট কমছে, ফিরছে জনগণের আস্থা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সংস্কার ও কঠোর নিয়মাবলীর প্রভাবে লুটপাটের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। রাজনৈতিক প্রভাবকে সরিয়ে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে, দেশের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও ব্যাংকিং খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
অতীতের ধস: অনিয়ম ও লুটপাটের গর্জন
গত দশকে বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং হাজার কোটি টাকা ঋণ পাচারের ঘটনা প্রকাশ পায়। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নাম মাত্রের ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে, আগের সরকারের সময়ে নিয়মবহির্ভূত ঋণের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে ১৪টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বদল করে, সংকট মোকাবিলায় নতুন নিয়ম-নীতি চালু করে। তবে এখনও ৬টি দুর্বল ব্যাংক পুরোপুরি পুনরুজ্জীবিত হতে পারেনি।
সংস্কারের ফল: লুটপাট কমেছে, আস্থা বাড়ছে
বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পর ব্যাংক খাতে দুর্নীতির মাত্রা কমে আসছে। গ্রাহকরা নতুন করে ব্যাংকের দিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। আমানত ও ঋণ সুবিধার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বেড়েছে বলে ব্যাংকাররা জানান।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, “বর্তমানে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে না। যদি রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবশালী শক্তি মাথাচাড়া না দেয়, তাহলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যত অত্যন্ত উজ্জ্বল।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, “৫ আগস্টের আগে যে লুটপাট চলছিল, এখন তা প্রায় বন্ধের পর্যায়ে। মূল সমস্যাটাই ছিল লুটপাট।”
তবে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়েছে
যদিও অনেকটা স্বচ্ছতা ফিরেছে, কিন্তু পুরোপুরি দুর্নীতি নির্মূল হয়নি। বিশেষ করে, খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেক ক্ষেত্রে অব্যবস্থা রয়েছে। অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত অনেক গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময় লাগছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষত শুষে উঠতে কিছুটা সময় প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, শুধুমাত্র নিয়ম তৈরি করলেই হবে না, সেগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোর মনোভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত সংস্কার।
বিশ্লেষকদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের উপর যে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, সেটি পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলে যেসব সংস্কার করা হচ্ছে, তা কার্যকর হবে না। কাঠামোগত ও আইনি সংস্কার ছাড়া ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন।”
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ এখন ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরানো ও উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থায়ন নিশ্চিত করা। যাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগ সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে।
সরকারের পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংক খাতের সংস্কারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে মিলিতভাবে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন ও কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালনায় স্বচ্ছতা, আর্থিক সুরক্ষা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অডিট ও তদারকি বাড়ানো হয়েছে।
তাছাড়া, খেলাপি ঋণ কমাতে এবং ঋণ গ্রহীতাদের ওপর কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত রোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশকে শক্তিশালী করবে।
ব্যাংক খাতের পরিবর্তনের গতি এবং দেশের অর্থনীতির উন্নতি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে লুটপাট কমে গ্রাহকদের আস্থা ফিরছে। তবে, সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার হতে এখনো সময় এবং কঠোর প্রচেষ্টা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস, আইন প্রয়োগের জোরদারকরণ এবং আধুনিক ব্যাংকিং প্রযুক্তি গ্রহণ ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে সহায়ক হবে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে তোলায় ব্যাংকিং খাতের উন্নতি অপরিহার্য। তাই সরকার, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত দৃষ্টান্তমূলক হয়ে ওঠে এবং দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করায়।