গুমে বাহিনীর ভেতর মতানৈক্য ও বিদেশি সংযোগ পেয়েছে কমিশন

দেশের গুম সংক্রান্ত ঘটনায় গঠিত অন্তর্বর্তী তদন্ত কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই ধরনের ভয়াবহ ঘটনায় শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী নয়, বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততাও রয়েছে। আরও বলা হয়েছে, বাহিনীর ভেতরে গভীর মতবিরোধ ও দ্বিধা রয়েছে, যা ‘গুম’ ও অন্য বেআইনি কার্যকলাপের পেছনে অন্যতম কারণ।
নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরকার দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কিছু সদস্য ‘গুম’ ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা এই অপরাধগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন না এবং অনেক সময় পেশাগত ও ব্যক্তিগত প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন। এমনকি তাঁদের পরিবার পর্যন্ত নজরদারির মুখে পড়েছে।
এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘গুম’ বিষয়ে নিরপেক্ষ মত প্রকাশের কারণে তাঁকে সহকর্মীদের মধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। নতুন পদায়নের আগেই সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়ত এবং তাঁর পরিবারের ওপর নজরদারি চলত।
কাঠামোগত সমস্যা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে, গুম একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। বরং এটি একটি কাঠামোগত সমস্যার অংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাত রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এই পরিস্থিতির পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে।
বর্ণনায় বন্দি নির্যাতন ও অবাধ্যতা
এক সৈনিক জানিয়েছে, তাঁকে গোপন বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে বন্দীদের প্রতি ছিল চরম নিষ্ঠুরতা। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বন্দীদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতে এবং সরাসরি কথা বলতেও নিষেধ করা হতো। ইশারা বা শিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা বাধ্যতামূলক ছিল।
তবু, ওই সৈনিক তাঁর সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও বন্দিদের প্রতি মানবিক সহানুভূতি দেখিয়েছেন। তাঁর দেওয়া খাবার অনেক বন্দীকে বাঁচিয়েছিল। এক বন্দী কমিশনকে সরাসরি জানিয়েছিলেন, ওই সৈনিকের খাবার খেয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন।
র্যাবের ভেতর বিরোধ ও অবাধ্যতা
এক র্যাব গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁকে এক বন্দীকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা অমান্য করেন। এমনকি দুই র্যাব সদস্য তাদের গোয়েন্দাপ্রধানকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তারা বেআইনি আদেশ পালন করবেন না। তাদের এই চিঠি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়েছিল। তবে, তারপরও গুমের মতো ঘটনা ঘটে, যেখানে লাশ ট্রেনলাইনের নিচে ফেলে গুম করা হয়েছিল।
বিদেশি অংশীদারিত্ব ও গুম
তদন্তে উঠে এসেছে, শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী নয়, বিদেশি শক্তি বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো এবং ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘গুম’ কার্যক্রমে সহযোগিতা করেছে।
এক ভুক্তভোগী কমিশনকে জানান, তাঁকে ডিবির হেফাজতে দুজন আমেরিকান নাগরিক জেরা করেছিলেন। যদিও তারা সরাসরি নির্যাতনে অংশ নেননি, তথাপি তাদের উপস্থিতি বেআইনি আটক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়।
‘গুম’ – শুধু একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, একটি কাঠামোগত সমস্যা
গুমের বিষয়টি বাংলাদেশের একটি গভীর ও শেকলছাড়া মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শুধু রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়, বিদেশি সংস্থার অবদান ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
বাংলাদেশে ‘গুম’ বা গায়েব হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে বহু বছরের ধরে বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে এবারকার কমিশনের রিপোর্টে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা দেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্নচিহ্ন সৃষ্টি করেছে।
‘গুম’ ও মানবাধিকার: আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ‘গুম’ কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় না, এটি সামাজিক ও মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা তাদের পরিবার সদস্যরা জীবনের জন্য সংগ্রাম করেন, যেখানে অনেক সময় বিচার পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ‘গুম’ সমস্যাকে সরাসরি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্কেত হিসেবে দেখছে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও অনেক সময় ওঠে।
গুমের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও আগামী পদক্ষেপ
বর্তমান তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে গুমের পেছনের গভীর কাঠামো ও বিদেশি অংশীদারিত্বের বিষয়টি সামনে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন প্রয়োজন আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কার এনে ‘গুম’ ঘটনা বন্ধ করার জন্য দৃঢ় উদ্যোগ গ্রহণ।
সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভুক্তভোগীদের বর্ণনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরকার মতবিরোধ বুঝতে সহায়ক হবে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
গুম একটি ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন, যার পেছনে রয়েছে গভীররকমের নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব। বাংলাদেশের সুশাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় ‘গুম’ বন্ধ করা অতীব জরুরি।
তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা দেশের রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান।
কীভাবে ‘গুম’ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব?
১. নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে মানবাধিকার সম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
৪. গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও সুষ্ঠু বিচার প্রদান করতে হবে।
৫. সমাজে ‘গুম’ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।