যুক্তরাষ্ট্র নেই, ইউরোপ কি একা পুতিনকে রুখতে পারবে

২০১৪ সালের পর থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বড় ধরনের সামরিক ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিল, অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলো সেভাবে এককভাবে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয়নি। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শিথিল নীতি এবং ইউরোপের একক অবস্থান যুদ্ধের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে — ইউরোপ কি একাই পুতিনকে থামাতে পারবে?
ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান: ইউক্রেন থেকে সরছে যুক্তরাষ্ট্র
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও পদক্ষেপগুলি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে যুক্ত থাকা উচিত নয়। তার এমন মনোভাবের কারণে ইউক্রেনকে প্রাপ্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য কমে এসেছে। এছাড়াও, ট্রাম্প ন্যাটো জোটকে অনেকবার অবমূল্যায়ন করেছেন এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে অবহেলা করেছেন।
ট্রাম্পের এ ধরনের অবস্থান ইউক্রেনের কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দ্বিতীয় দফার শান্তি আলোচনা ইস্তাম্বুলে ভেঙে যাওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা কমে যাওয়ায় ইউক্রেনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
ইউরোপের একাকীত্ব এবং যুদ্ধের দায়ভার
যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কমে যাওয়ার ফলে ইউরোপ একাকী হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো দেশের উপর এখন যুদ্ধ পরিচালনা ও রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকানোর দায় ভারী হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইউরোপের সামরিক প্রস্তুতি ও অস্ত্রশিল্প এখনও পুরোপুরি সক্ষম নয়। ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জামের প্রায় ৩০ শতাংশ সরবরাহ করেছিল ইউরোপ, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
২০২৫ সালের প্রথম দিকে ইউক্রেনের সামরিক চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশই নিজস্ব উৎপাদিত অস্ত্র ও সরঞ্জামে পূরণ করত। বাকিটা আসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু ইউরোপের অস্ত্রশিল্প দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে থাকায় গোলাবারুদের স্বল্পতা অনুভূত হচ্ছে।
চেক প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ ইউক্রেনকে ১৮ লাখ কামান গোলা সরবরাহ করবে। এতে কানাডা, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কসহ কয়েকটি দেশ অংশ নিচ্ছে। এছাড়া জার্মানি ও ইউক্রেনের মধ্যে দীর্ঘ পাল্লার অস্ত্র উৎপাদনের চুক্তি হয়েছে। ব্রিটেনও এক নতুন ড্রোন প্যাকেজের মাধ্যমে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করবে।
ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা: রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর প্রভাব
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপ ২০১৪ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে, যা ২০২২ সালের আগ্রাসনের পর তীব্রতর হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ১৭ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য সম্প্রতি সবচেয়ে বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা প্রয়োগ হলে রাশিয়ার বার্ষিক ক্ষতি ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে হতে পারে।
ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাইজা কাল্লাস বলেছেন, “যতদিন রাশিয়া যুদ্ধ চালাবে, আমাদের জবাব তত কঠিন হবে।” এই নিষেধাজ্ঞা শুধু অর্থনৈতিক চাপই তৈরি করেনি, বরং রাশিয়ার যুদ্ধ চালানোর সক্ষমতাকেও দুর্বল করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ: আর্থিক ও মানবিক সহযোগিতার চিত্র
যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনকে প্রায় ১২৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, যার মধ্যে ৬৬.৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তার সদস্যদেশগুলো ১৩৫ বিলিয়ন ইউরো দিয়েছে, যার মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ইউরো সামরিক, ৬৭ বিলিয়ন ইউরো আর্থিক ও মানবিক, এবং ১৭ বিলিয়ন ইউরো শরণার্থী সহায়তা। যুক্তরাজ্যও দিয়েছে ১২.৮ বিলিয়ন পাউন্ড।
এই অর্থগুলো দান নয়, বরং একটি কৌশলগত বিনিয়োগ, কারণ রাশিয়ার জয় ইউক্রেন ও ইউরোপের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করবে।
যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এবং ইউরোপের ভূমিকা
যুদ্ধ এখন শুধু ইউক্রেনের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি ইউরোপের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে ইউরোপের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে, যা নতুন ধরনের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত পরিকল্পনা দাবি করে।
ইউরোপকে দ্রুতই সামরিক শিল্প ও সামরিক সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। অস্ত্র উৎপাদন, ড্রোন ব্যবহারের উন্নয়ন এবং নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়নে আরও কঠোর হতে হবে। ইউরোপের সামরিক ও কূটনৈতিক ঐক্যই নির্ধারণ করবে এই যুদ্ধে পুতিনের আগ্রাসন রুখে দেওয়া সম্ভব হবে কি না।
ইউরোপের সামনে এক ইতিহাসিক চ্যালেঞ্জ
যদি ইউরোপ একা থেকে রাশিয়ার আগ্রাসন রুখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইউক্রেন হারাবে এবং ইউরোপের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। স্বাধীন ও নিরাপদ ইউরোপ গড়ার স্বপ্ন সঙ্গীন হুমকির মুখে পড়বে। ইউরোপের এখন সময় কাজের মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদানের। শুধুমাত্র কথায় নয়, কর্মে ইউরোপকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা বিশ্বমঞ্চে নিজের ভূমিকা পালনে সক্ষম।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই এখন শুধু ইউক্রেনের নয়, এটি ইউরোপের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই।