বিশ্ব

আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করলো কাতার

মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে কাতার সাময়িকভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সোমবার (২৩ জুন, ২০২৫) দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার বরাতে বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত দেশের নাগরিক, বিদেশি ভ্রমণকারী এবং কাতারে অবস্থানরত সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।

সিদ্ধান্তের পটভূমি

কাতারের এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। গত শনিবার (২২ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা—ফরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহানে—বিমান হামলা চালায়। মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা জেনারেল ড্যান কেইন জানিয়েছেন, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে এই অভিযানে সাতটি বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান, ১৪টি বাঙ্কার-ধ্বংসকারী বোমা, দুই ডজন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১২৫টিরও বেশি সামরিক বিমান ব্যবহৃত হয়েছে। এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এই হামলাকে কূটনীতির ধ্বংস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, “ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন বন্ধ না হলে আমাদের প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, ইরানের পার্লামেন্ট বিশ্ব জ্বালানি বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব পাস করেছে। এই প্রণালি দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল ও গ্যাস সরবরাহ হয়, এবং এটি বন্ধ হলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

কাতারের ভূমিকা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ

কাতার মধ্যপ্রাচ্যের একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি ‘আল-উদেইদ’ অবস্থিত। এই ঘাঁটিতে প্রায় ১০,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, যা মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের সম্মুখ সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইরানের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলার হুমকির পর কাতারে মার্কিন নাগরিকদের জন্য উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। একটি ইমেইল বার্তায় কাতারে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে আমরা আঞ্চলিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।” তিনি আরও জানিয়েছেন, কাতার যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করছে এবং যুদ্ধবিরতির জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলোর প্রতিক্রিয়া

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমা এড়িয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইট-রাডার টুয়েন্টিফোরের তথ্য অনুযায়ী, ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং ইসরায়েলের আকাশসীমার ওপর দিয়ে কোনো বিমান চলাচল করছে না। এয়ারলাইনগুলো বাড়তি সময় ও জ্বালানি খরচ সত্ত্বেও কাস্পিয়ান সাগর এবং মিশর ও সৌদি আরবের মধ্য দিয়ে বিকল্প রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

এই প্রেক্ষাপটে কাতার এয়ারওয়েজ, যিনি সম্প্রতি বিশ্বের সেরা এয়ারলাইন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদের ফ্লাইট পরিচালনায়ও পরিবর্তন আনছে। এয়ারলাইনটি জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

হরমুজ প্রণালি বন্ধের আশঙ্কা

ইরানের পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব পাস হওয়ায় বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রণালি বন্ধ হলে তেল ও গ্যাসের দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বাড়াবে। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান ডুবো খনি বা ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত দ্রুতগামী নৌযান ব্যবহার করে এই প্রণালি বন্ধ করতে পারে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সতর্ক করে বলেছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা ইরানের জন্য “অর্থনৈতিক আত্মহত্যা” হবে। তিনি চীনকে এই বিষয়ে মধ্যস্থতার আহ্বান জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরান-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিমুখী সংঘাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভক্ত। জি-৭ জোট ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের বিরোধিতা করলেও গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্ক সরাসরি মার্কিন হামলার নিন্দা না করে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য সতর্কতা জারি করেছে। তুরস্কের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, “তুরস্ক ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরোধিতা করে, তবে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও সমর্থন করে না।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়েতি মধ্যপ্রাচ্যের সব মার্কিন ঘাঁটিকে ইরানের বৈধ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই হুমকির পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রভাব

ইরান-মার্কিন উত্তেজনা এবং কাতারের আকাশসীমা বন্ধের সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। কাতার বিশ্বের বৃহত্তম তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি, এবং হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এই সরবরাহ ব্যাহত হবে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট রুটে ব্যাঘাত ঘটছে, যা ভ্রমণ ও বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলার আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে রয়েছে। তেহরানের বাসিন্দারা শঙ্কিত, এবং অনেকে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। তেহরানের একজন বাসিন্দা সারা বলেন, “শান্তি এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়, মনে হচ্ছে তা কবেই ধ্বংস হয়ে গেছে।”

উপসংহার

কাতারের আকাশসীমা বন্ধের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকটের গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে। ইরান-মার্কিন উত্তেজনা এবং হরমুজ প্রণালি বন্ধের আশঙ্কা বৈশ্বিক জ্বালানি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা। কাতার ও ওমানের মতো দেশগুলো এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা এখনও বিরাজমান।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button