বিশ্ব

তেহরানের ‘কুখ্যাত’ এভিন কারাগারে ইসরাইলের হামলা

তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এভিন কারাগারে ইসরাইলি বিমান হামলা চালানোর ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এই হামলায় কারাগার ও তার আশপাশে বড় ধরনের বিস্ফোরণের পর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় অঞ্চলটি।

সোমবার ভোররাতে ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তরে অবস্থিত এভিন কারাগারে বিস্ফোরণ ঘটে। স্থানীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি ছিল একটি সুনির্দিষ্ট বিমান বা ড্রোন হামলা, যার পেছনে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, কারাগারের মূল ফটকের কাছে প্রবল বিস্ফোরণের পর এলাকা ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি।

এভিন কারাগারের পরিচিতি ও কুখ্যাতি

তেহরানের উপকণ্ঠে অবস্থিত এভিন কারাগার ইরানের অন্যতম কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এটি কুখ্যাত রাজনৈতিক বন্দিশিবির হিসেবে পরিচিত, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ও বিদেশি নাগরিকদের আটক রাখা হয়।

পশ্চিমা দেশগুলো একাধিকবার এ কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজরদারিতে থাকা এই কারাগার এর আগেও বহুবার আলোচনায় এসেছে।

ইসরায়েলের দাবি ও প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এই হামলার ব্যাপারে জানিয়েছেন, “ইরানি শাসনব্যবস্থার দমন যন্ত্র ও নিরাপত্তা কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করেই আমাদের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরে একটি গুলিও পড়লে, ইরানি স্বৈরশাসককে এর ফল ভোগ করতে হবে।”

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, হামলায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর একাধিক সদস্য নিহত হয়েছে। তারা জানিয়েছে, হামলার লক্ষ্য ছিল আইআরজিসির সদর দফতর, বাসিজ বাহিনীর ঘাঁটি, অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিট এবং সাধারণ নিরাপত্তা পুলিশের কেন্দ্র।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

এই হামলার ঘটনায় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা হামলার বিস্তারিত পর্যালোচনা শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভিন কারাগারে হামলা আন্তর্জাতিক কূটনীতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু এই কারাগার বহু কূটনৈতিক আলোচনায় ‘বিনিময় কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই এর ওপর হামলা ভবিষ্যতের বন্দি বিনিময় বা মানবাধিকার ইস্যুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা

সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর থেকে ইরান ধারাবাহিকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালিয়ে আসছে।

এরই প্রেক্ষিতে ইসরায়েলও ইরানের ভেতরে পাল্টা হামলা শুরু করে। গত ১৩ জুন ইরানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। নতুন করে এভিন কারাগারে হামলা সেই উত্তেজনারই অংশ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. হাসান আরিফ বলেন, “এভিন কারাগারের ওপর হামলা নিছক প্রতিশোধ নয়; বরং এটি ছিল ইরানের ভেতরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।”

তিনি আরও বলেন, “এভিন কারাগার শুধু একটি কারাগার নয়, এটি ইরানের দমননীতির প্রতীক। ইসরায়েল সেখানে হামলা চালিয়ে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে— তারা ইরানের হৃদয়ে আঘাত হানতে সক্ষম।”

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির শঙ্কা

বিশ্লেষকদের মতে, এ হামলা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। একদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতি উত্তপ্ত হবে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যেতে পারে।

জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই অঞ্চলটিতে শান্তি রক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। তবে ইরান সরকার এখনো কোনো প্রতিশোধমূলক হুমকি না দিলেও, আগামি কিছু দিন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।

“এটি নিছক প্রতিশোধ নয়, বরং ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানো এক কৌশলগত বার্তা”—মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. হাসান আরিফ

তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে ইসরায়েলের হামলা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এর প্রভাব শুধু ইরান-ইসরায়েলের দ্বন্দ্বে নয়, বরং সামগ্রিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও পড়বে।

তবে প্রশ্ন রয়ে গেল— এই উত্তেজনার পরিণতি কী হবে? ইরান কীভাবে জবাব দেবে? শান্তির পথে কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

এম আর এম – ০০১১, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button