বানিজ্য

হরমুজ প্রণালি এড়িয়ে চলছে তেলবাহী জাহাজ, বাড়ছে জ্বালানির দাম

সম্প্রতি ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলার ফলে আন্তর্জাতিক তেলবাজারে জ্বালানির দাম পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হামলা আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে অস্থিরতা তৈরি করেছে এবং ভবিষ্যতে তেলের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সের সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানে সংঘটিত এই সশস্ত্র হামলার পর থেকেই তেলের বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং হরমুজ প্রণালির আশেপাশে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ বাড়ছে।

হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব ও সংকটের প্রভাব

হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ তেলপথ। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার টন তেল বহনকারী ট্যাংকার পাস করে, যা বিশ্ববাজারের জ্বালানির নিরাপদ সরবরাহের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার কারণে, এই রুট দিয়ে চলাচলকারী তেলবাহী জাহাজগুলো অন্য পথ বেছে নিচ্ছে বা হরমুজ প্রণালির নৌরুট থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবস্থায় হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা ও অব্যাহত চলাচল তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এই প্রণালির মাধ্যমে পাস হওয়া তেলের পরিমাণ বিশ্ব বাজারের মোট সরবরাহের বড় অংশ। যদি এই পথ বন্ধ থাকে বা সংকুচিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক তেলের দাম বাড়তে বাধ্য।

আন্তর্জাতিক তেলের দাম: বর্তমান পরিস্থিতি

  1. ব্রেন্ট ক্রুড তেল: বিশ্বমানের সূচক ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বর্তমানে ব্যারেল প্রতি ৭৮.৯৩ ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের দিনের তুলনায় ১.৯২ ডলার বেশি।
  2. ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI): যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত WTI তেলের দাম বেড়ে ৭৫.৭৩ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের চেয়ে ১.৮৯ ডলার বেশি।

এই ঊর্ধ্বমুখী দাম বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও তেল আমদানিকারক দেশগুলো যেমন চীন, ভারত, জাপান, ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নানান দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায়:

  1. জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যাহত হলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাবে।
  2. শিল্প উৎপাদন খরচ বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে।
  3. পণ্য ও সেবার মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেবে।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ইতিমধ্যে সতর্ক করেছেন যে তেলের দাম বেড়ে গেলে উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও বেশি আর্থিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে।

তেলবাহী জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিকল্প রুট

বর্তমানে হরমুজ প্রণালী এড়িয়ে চলার ফলে তেলবাহী জাহাজগুলো দীর্ঘ ও বিপজ্জনক বিকল্প নৌরুট বেছে নিচ্ছে। এই বিকল্প রুটগুলো মূলত পেরশিয়ান উপসাগরের বাইরে গিয়ে ওমান সাগরের দিকে ঘুরে যাওয়ার ব্যবস্থা। এতে সময় এবং জ্বালানি খরচ উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

তবে নিরাপত্তার দিক থেকে এটি জরুরি, কারণ সাম্প্রতিক হামলা ও উত্তেজনার কারণে হরমুজ প্রণালী অত্যন্ত অস্থির। ইতোমধ্যে দুইটি তেলবাহী জাহাজকে হরমুজ প্রণালির নৌরুট থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা: কিভাবে শুরু হলো?

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার মূল কারণ হলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক প্রভাব বিস্তার। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলা ইরানের নিকটবর্তী কিছু স্থাপনা লক্ষ্য করে, যা ইরানের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপকে আরও তীব্র করেছে।

এই সংঘাতের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও প্রণালীসমূহ নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে, যা সরাসরি আন্তর্জাতিক তেলের বাজারকে প্রভাবিত করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও পরামর্শ

বিশ্বের বড় বড় দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্রুত শান্তি ও স্থিতিশীলতার আহ্বান জানাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও কূটনৈতিক চাপ ছাড়া এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে।

সামগ্রিক পর্যালোচনা

  1. ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কারণে তেলের বাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি।
  2. হরমুজ প্রণালী এড়িয়ে তেলবাহী জাহাজের চলাচল, নিরাপত্তার উদ্বেগ বাড়ছে।
  3. তেলের দাম গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
  4. বিশ্ব অর্থনীতিতে তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব।
  5. আন্তর্জাতিক শান্তি প্রক্রিয়ার ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা।

আমাদের জন্য বার্তা

বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজকে দ্রুত ও কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ নিরাপদ থাকে এবং দাম স্থিতিশীল হয়। এর পাশাপাশি বিকল্প শক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, যা ভবিষ্যতে তেলভিত্তিক সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button