নবীন বাজেটে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন: ২১৪৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ২১৪৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এটি মেয়র শাহাদাত হোসেনের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বাজেট ঘোষণা, যা নগরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্ব আরোপ করেছে। আজ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত বাজেট অধিবেশনে এই ঘোষণা দেন মেয়র।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের প্রধান আকার-প্রকৃতি
- মোট বাজেট: ২১৪৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা
- সংশোধিত বাজেট ২০২৪-২৫: ১২২১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা (মূল বাজেট ছিল ১৯৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা)
- বাজেট বাস্তবায়নের হার: ৬১.৬৬ শতাংশ
- নিজস্ব আয়: ১০৪৫ কোটি ২১ লাখ টাকা
- সরকারি অনুদান: ১০৯২ কোটি ৫ লাখ টাকা
মেয়র শাহাদাত হোসেনের বক্তব্য
মেয়র শাহাদাত হোসেন বাজেট অধিবেশনে বলেন, “২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের উন্নয়ন পথে নতুন সূচনা হয়েছে। আমি এই দায়িত্ব নিয়ে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট। নগরকে ক্লিন-গ্রিন, নিরাপদ, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করব।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চারটি মূল ক্ষেত্রের ওপর জোর দেবো: দক্ষ জনবল গঠন, সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন, নতুন জনবল নিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি।”
বাজেটের গুরুত্বপূর্ন খাতসমূহ
১. জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ বরাদ্দ
চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম বৃহৎ সমস্যা জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় এবার বাজেটে ৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৩৩ কোটি টাকার তুলনায় ব্যাপক বৃদ্ধি। মেয়র জানিয়েছেন, নগরের ১৯টি খাল থেকে প্রায় ৪১ লাখ ঘনফুট মাটি ও আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। এ জন্য ১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এছাড়াও নালা-নর্দমা পরিষ্কারে ১৪৮টি প্রকল্পে ৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে এবং বর্ষার আগেই আরও ২০০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
২. নগর সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন
বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, যা নগরের রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ এবং অন্যান্য স্থাপনার সংস্কার ও নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যেমন গুলশান, আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে নৌবাহিনীকে দিয়ে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার কাজ চলমান রয়েছে।
৩. পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ
৬৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে। এর মধ্যে বেতন-ভাতা খাতের জন্য বরাদ্দ ৩৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
৪. মশকনিধন
মশকনিধনে বরাদ্দ এবার কম হয়েছে, মাত্র ৯ কোটি টাকা। আগের বছর ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, তবে মাত্র ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। নতুন বাজেটে আধুনিক পদ্ধতি ও আমেরিকান প্রযুক্তির ‘লার্ভিসাইড’ ব্যবহারের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও কার্যকর করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
নতুন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা
- ডিজিটালাইজেশন: সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মেয়র, যা নগরবাসীর জন্য সেবাগুলোকে সহজতর করবে।
- কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ: দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- নতুন জনবল নিয়োগ ও সাংগঠনিক কাঠামো: বর্তমান কাজের পরিধি ও ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় নতুন কর্মী নিয়োগ ও সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদনের জন্য প্রস্তুতি চলছে।
দেনা কমানোর চ্যালেঞ্জ ও অগ্রগতি
মেয়র জানিয়েছেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় সিটি করপোরেশনের দেনা ছিল প্রায় ৫৯৬ কোটি টাকা। গত ৮ মাসে ধারাবাহিকভাবে দেনা পরিশোধের ফলে এখন তা কমে প্রায় ৪০০ কোটি টাকায় এসেছে। এটি নগরের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং স্থিতিশীলতার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
চট্টগ্রাম নগরের ভবিষ্যৎ: এক স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিলন
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের বাণিজ্য ও শিল্পকেন্দ্র হওয়ায় নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সঠিক বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। জলাবদ্ধতা, যানজট, আবাসন সংকট, দূষণ ও নাগরিক সেবায় আধুনিকীকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে একসঙ্গে সমাধানের চেষ্টা চলছে। মেয়র শাহাদাত হোসেনের প্রথম বাজেটে এসব বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা নগরের বাসিন্দাদের জন্য সুখবর।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নাগরিক জীবনের মান উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও বাজেট বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলে, চট্টগ্রাম দ্রুত একটি আধুনিক, বাসযোগ্য, পরিবেশবান্ধব ও প্রযুক্তিনির্ভর মহানগরীতে পরিণত হবে।