নববির জীবন ও আদর্শ: এক মহান আলেম ও যুগান্তকারী শিক্ষাবিদের কাহিনি

ইমাম নববি, যিনি ইমাম মুহিউদ্দিন আবু জাকারিয়া আন-নববি নামে পরিচিত, তাঁর পুরো নাম ইয়াহিয়া ইবনে শারাফ ইবনে মুরি ইবনে হাসান। ডাকনাম ছিল আবু জাকারিয়া অর্থাৎ জাকারিয়ার বাবা। ‘মুহিউদ্দিন’ উপাধি তাঁর অর্থ “দীনকে জীবনদানকারী” — এটি তার জীবন ও কাজের সার্থক প্রতিফলন। তিনি ছিলেন কেবল একজন আলেম নন, বরং এক আদর্শিক মানুষ যাঁর জীবন ছিল পবিত্র জ্ঞানার্জন ও সত্যনিষ্ঠার অনন্য দৃষ্টান্ত।
জন্ম ও শৈশব: নবাবাসী ইমামের জীবন শুরু
৬৩১ হিজরি সনে সিরিয়ার হাওরান অঞ্চলের নবায় জন্মগ্রহণ করেন ইয়াহিয়া, যার জন্য তাঁকে ‘নববি’ বা ‘নবার অধিবাসী’ নামে ডাকা হয়। কৈশোর থেকেই তাঁর কোরআন প্রতি গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়। তাঁর সহপাঠীরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকলেও, ইমাম নববি কাঁদতে কাঁদতে কোরআনের মুখস্থ পাঠ করতেন। তাঁর শিক্ষক তাজুদ্দিন আস-সুবকি এই দৃশ্য স্মরণ করে লিখেছেন, “এই শিশু একদিন তার যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম হবে।”
শিশুকালেই কোরআন হিফজ সম্পন্ন করার পর, তিনি গভীরভাবে ইসলামী বিদ্যায় নিমগ্ন হন।
ইলমের পথচলা: অক্লান্ত পরিশ্রম ও শিক্ষাগ্রহণ
দামেস্কে এসে তিনি শফাঈ ফিকহে শিক্ষালাভ শুরু করেন প্রখ্যাত মুফতি তাজুদ্দিন আল-ফাজারির অধীনে। এছাড়াও, মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল-মাকদিসি, ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম, আহমদ ইবনে আবদুদ দাইমসহ অন্যান্য আলেমদের থেকে হাদিস ও ইসলামী শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ছয় বছর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন হয়ে ওঠেন।
পথ চলার সময়ও তিনি মুখস্থ জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর জীবন ছিল সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানার্জনের এক অসাধারণ নিদর্শন।
তাকওয়া ও সত্যনিষ্ঠার জীবন্ত উদাহরণ
ইমাম নববির জীবন ছিল তাকওয়া (খোদাভীতি) ও সত্যনিষ্ঠার এক অনন্য মিশ্রণ। তিনি ছিলেন গুরুগম্ভীর, হাসি-তামাশায় কম অংশগ্রহণকারী, কিন্তু সত্যের কথা বলতেও কখনো পিছপা হননি। শাসকদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে তিনি সাহসী নসিহতকারী ছিলেন। দৈনন্দিন জীবনেও তিনি নিজেকে একদম সাধারণ ও সংযমিত রাখতেন — দিনে মাত্র একবার খাবার গ্রহণ করতেন এবং কারো কাছ থেকে অনুরোধ বা উপকার নিতেন না।
ইবনে কাসিরের বর্ণনায়, “তিনি ছিলেন জ্ঞান, আমল ও খোদাভীতির অপূর্ব সমন্বয়, তাঁর মত আর কেউ ছিলেন না।”
শাফাঈ মাজহাবের মুকুট ও তাঁর গৌরব
ইমাম নববি শাফাঈ মাজহাবের নিয়ম-কানুনে পারদর্শী ছিলেন। তাকে ‘মাজহাবের সম্পাদক’ বলা হত, কারণ তিনি মাজহাবের সকল নিয়ম, প্রমাণাদি ও পার্থক্যের বিষয়টি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বুঝতেন এবং ব্যাখ্যা করতেন। হাদিসের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সবার উপরে সূক্ষ্মদর্শী, সহিহ ও দুর্বল হাদিস চিহ্নিতকরণে তাঁর দক্ষতা অতুলনীয় ছিল।
গ্রন্থাবলি: ইসলামী জ্ঞানের অমূল্য ধন
মাত্র ৪৫ বছর বয়সে জীবনের ইমাম নববি বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা আজও মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ‘রিয়াদুস সালিহীন’ — যা একটি বিশাল হাদিস সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা।
- ‘আল-আযকার’ — যেটি আজও মুসলিমদের দৈনন্দিন দোয়া ও ইবাদতের প্রধান গ্রন্থ।
- ‘আল-মিনহাজ ফি শারহ সহিহ মুসলিম’ — সহিহ মুসলিম হাদিসের বিশদ ব্যাখ্যা।
- ‘রওযাতুত তালিবীন’ ও ‘উমদাতুল মুফতিয়ীন’ — শাফাঈ ফিকহের প্রধান গ্রন্থ।
- ‘আত-তিবইয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কোরআন’ — কোরআনের আদব নিয়ে লেখা অনন্য রচনা।
সমালোচনা ও প্রশংসা
যদিও কিছু সমালোচনা তাঁর প্রতি ওঠে, তা কখনোই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। বরং মুসলিম আলেম সমাজ তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে ‘শাইখুল ইসলাম’ ও ‘মানবজাতির গৌরব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইবনে কাসির বলেন, “তিনি ছিলেন ফিকহের শীর্ষে, তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।” ইমাম জাহাবি বলেন, “তার গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা অনন্য।”
ইমামের ইন্তেকাল ও স্মরণ
৬৭৬ হিজরির ২৪ রজব, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাতৃভূমি নবায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো দামেস্ক শোকে ভেঙে পড়ে। বিশিষ্ট আলেম ও কাজিদের মধ্যে কাজি ইজ্জুদ্দিন মুহাম্মদ ইবন সাইগসহ অনেকে তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।
ইমাম নববির জীবনের শিক্ষা
ইমাম নববির জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি—
- কিভাবে সততা ও ধার্মিকতা জ্ঞান অর্জনের সাথে মিলিয়ে চলতে হয়।
- কঠোর অধ্যবসায় ও ধৈর্যের মাধ্যমে কিভাবে একজন আলেমের উচ্চতা অর্জন সম্ভব।
- সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ন্যায্যতার পথে দাঁড়িয়ে কিভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়।
তার জীবন আজকের দিনে নবীন শিক্ষার্থী থেকে প্রৌঢ় পণ্ডিত পর্যন্ত সকলের জন্য এক অমুল্য দৃষ্টান্ত।