অর্থনীতি

নতুন যুগের রেমিট্যান্স প্রবাহ: তিন সপ্তাহে ১৯৮ কোটি ডলার প্রবাসী আয়

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। চলতি জুন মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাঠিয়েছেন মোট ১৯৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গত বছরের জুনের প্রথম তিন সপ্তাহে প্রাপ্ত প্রবাসী আয় ছিল ১৯১ কোটি ডলার, যা এই বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৮ কোটি ডলারে।

প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি ও বৈধ রেমিট্যান্স পথের জনপ্রিয়তা

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বৈধ পথে প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ অর্থ পাচারের পরিমাণ কমে আসা এবং বৈধ পথে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সুবিধার বৃদ্ধির ফলে প্রবাসীরা সরকারি অনুমোদিত চ্যানেলগুলোকে বেছে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষ তিন দিনে প্রবাসীরা ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি ৪৩ লাখ ডলার প্রবাহের স্বচ্ছ ইঙ্গিত।

ডলারের সংকট দূর, স্থিতিশীল বাজার

দেশের ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ডলারের সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। এর পাশাপাশি ডলারের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সর্বোচ্চ দর প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা রক্ষা করছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে রয়েছেন এবং বাজারে ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে অভাবনীয় বৃদ্ধি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২১ জুন পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় হয়েছে ২,৯৫০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৭ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাঠান। বিশেষ করে গত মে মাসে প্রবাসী রেমিট্যান্স হয়েছে ২৯৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেশি। মে মাসের প্রথম তিন দিনে একাই দেশে এসেছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা দেশের অর্থনীতিতে শক্তি যোগাচ্ছে।

মাস ভিত্তিক রেমিট্যান্স পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস ব্যতীত, প্রতিটি মাসেই দুইশ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। মার্চ মাসে সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স হয়েছে। এছাড়া মে মাসে ২৯৭ কোটি এবং এপ্রিলে ২৭৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স প্রবাহিত হয়েছে।

প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি: বৈদেশিক মুদ্রার দুই স্তম্ভ

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি উৎস হল প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং পণ্য রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশ ৪,৪৯৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.২০ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয় ও রপ্তানির এ ইতিবাচক প্রবণতা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

প্রবাসী আয়ের বিশেষ গুরুত্ব

প্রবাসী আয় হচ্ছে দেশের জন্য একমাত্র দায়বিহীন বৈদেশিক মুদ্রা উৎস, কারণ এটি বিদেশ থেকে সরাসরি আয়, যেখানে কোন বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না। অন্যদিকে পণ্য রপ্তানিতে বিদেশি মুদ্রা আসলেও কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ডলার ব্যয় করতে হয়। এছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধেও ডলারের প্রয়োজন হয়। তাই প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য খুবই জরুরি।

প্রবাসীদের অবদান: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি

প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। বিদেশে তাদের পরিশ্রম ও অর্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর মাধ্যমে দেশের হাজারো পরিবার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালিত হয়। এই অর্থ বিনিয়োগ, ব্যবসা সম্প্রসারণ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক অবকাঠামো গঠনে সহায়ক।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা

সরকার এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও সহজ ও নিরাপদ করার জন্য। ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম এবং বৈধ অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের সুবিধার্থে নতুন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চার; তিন সপ্তাহে ১৯৮ কোটি ডলার অর্জন দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনারই প্রমাণ। বৈধ পথে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি, ডলারের সংকট কাটিয়ে ওঠা, ও ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা দেশের আর্থিক ভবিষ্যৎকে মজবুত করবে। প্রবাসীদের অবদান ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অসম্ভব, তাই তাদের জন্য নিরাপদ ও সহজ রেমিট্যান্স ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button