ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর বিশ্ববাজারে এবার কী হতে পারে

২২ জুন ২০২৫, ঢাকা – ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলা বিশ্ববাজারে এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে তীব্র অস্থিরতা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক অভিযানের প্রভাব তেলের দামে তীব্র উত্থান, বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ সম্পদে ঝোঁক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলা: ট্রাম্পের ঘোষণায় উত্তেজনার ঢেউ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ সরাসরি হামলার তথ্য জানান। তিনি ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাকে ‘চমকপ্রদ সামরিক সাফল্য’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং হুঁশিয়ারি দেন, শান্তিচুক্তিতে ইরান না গেলে আরও হামলা হতে পারে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে।
বাজারে প্রাথমিক প্রভাব ও বিনিয়োগকারীদের মনোভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলার পর বাজারে প্রথমে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। মার্ক স্পিন্ডেল, পোটোম্যাক রিভার ক্যাপিটালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, বলেন, “তেলের দাম দ্রুত বাড়তে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ যেমন ডলার ও বন্ডের দিকে ঝুঁকবেন।”
তবে তিনি বলেন, হামলার ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি মূল্যায়ন করতে এখনো সময় লাগবে।
তেলের বাজার: দাম বাড়ার সম্ভাবনা ও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা
মধ্যপ্রাচ্যের অব্যাহত উত্তেজনার প্রেক্ষিতে তেলের দাম গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ১০ জুন থেকে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রায় ১৮% বেড়ে ৭৯ ডলার/ব্যারেলে পৌঁছেছে, যা পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাতের কারণে তেলের বাজার অস্থির।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সংঘাত আরও বাড়ে এবং হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তেলের দাম ১৩০ ডলারে উঠে যেতে পারে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ৬% পর্যন্ত উঠতে পারে, যা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিতে প্রভাব: মূল্যস্ফীতি, সুদের হার ও বিনিয়োগের ঝুঁকি
জ্যাক অ্যাবলিন, ক্রেসেট ক্যাপিটালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, বলেন, “তেলের দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে মুদ্রানীতিতে এবং অর্থনীতির অন্যান্য খাতে।”
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়ানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করবে, যা স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগ ও ভোক্তা ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শেয়ারবাজারে প্রভাব ও ইতিহাসের পর্যালোচনা
ইতিহাসের আলোকে দেখা গেছে, যুদ্ধ কিংবা বড় রাজনৈতিক সংঘাতের সময় শেয়ারবাজার প্রথমে পতনের মুখে পড়লেও পরবর্তীতে স্থিতিশীল হয়। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ এবং ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার সময় শেয়ারবাজার কিছুদিন পতিত হলেও পরে পুনরুদ্ধার হয়েছে।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজ ও ক্যাপআইকিউ প্রোর তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত শুরু হওয়ার পর প্রথম তিন সপ্তাহে মার্কিন এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক গড়ে ০.৩% কমে যায়, কিন্তু দুই মাস পর তা ২.৩% পর্যন্ত বেড়ে যায়।
ডলারের ভূমিকায় পরিবর্তন ও নিরাপদ আশ্রয়ের চাহিদা
বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ডলারের মান কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে এই হামলার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ডলারের চাহিদা বাড়তে পারে।
আইবিকেআরের প্রধান বাজার কৌশলবিদ স্টিভ সোসনিক বলেন, “নিরাপদ সম্পদে দৌড়ঝাঁপ দেখা যেতে পারে, যার ফলে বন্ডের সুদহার কমবে এবং ডলার শক্তিশালী হবে।”
ভবিষ্যত সম্ভাবনা: শান্তিচুক্তির আশা ও অস্থিরতা
হ্যারিস ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের ম্যানেজিং পার্টনার জেমি কক্স আশা প্রকাশ করেছেন, “এই ধরণের সংঘাত সাময়িক এবং শীঘ্রই দাম স্থিতিশীল হতে পারে। ইরান হয়তো ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে।”
তবে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন হলেও, সংঘাতের গতি এবং ভবিষ্যত শান্তি আলোচনা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সার্বিক পর্যালোচনা: বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা?
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা বিশ্ববাজারে তেলের দাম এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদে ঝুঁকছেন, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা চলছে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সমন্বিত ও শান্তিপূর্ণ উদ্যোগ জরুরি। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার না হলে, বিশ্ববাজারে প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হতে পারে।