জাতিসংঘের কালোতালিকায় আবারও ইসরায়েল, গাজায় শিশুদের ওপর সহিংসতা নিন্দনীয়

জাতিসংঘ আবারও ইসরায়েলকে ‘কালোতালিকা’ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন সশস্ত্র সংঘর্ষের অঞ্চলে শিশুদের ওপর সংঘটিত মারাত্মক সহিংসতার জন্য ইসরায়েলি বাহিনীকে দায়ী করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গাজার ২০ মাস ধরে চলা নৃশংস হামলার প্রেক্ষাপটে এই কালোতালিকায় ইসরায়েলের নাম যুক্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের বার্ষিক ‘চিলড্রেন ইন আর্মড কনফ্লিক্ট’ (Children in Armed Conflict) প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শিশুদের ওপর সহিংসতা নজিরবিহীন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে গাজা উপত্যকা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী প্রধান দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী শিশুদের ওপর সহিংসতার সংখ্যা উদ্বেগজনক
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছরে বিশ্বজুড়ে শিশুদের ওপর মারাত্মক সহিংসতার ঘটনা ২৫% বেড়েছে। গত বছর ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিরুদ্ধে ৪১,৩৭০টি গুরুতর সহিংসতার তথ্য যাচাই করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ড, অঙ্গহানি, যৌন নির্যাতন, স্কুল ও হাসপাতালের ওপর হামলা।
এই সহিংসতার মধ্যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও ইসরায়েলে ঘটেছে ২ হাজার ৯৫৯ শিশুর ওপর ৮ হাজার ৫৫৪টি গুরুতর সহিংসতার ঘটনা। যার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ২ হাজার ৯৪৪ এবং ইসরায়েলি শিশু ১৫ জন।
গাজার শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ২০২৪ সালে ১ হাজার ২৫৯ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত এবং ৯৪১ শিশু আহত হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে গাজার উপর ইসরায়েলের বোমা হামলা অব্যাহত রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
অধিকৃত পশ্চিম তীরে, বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমে ৯৭ ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যু এবং ৩৬৮টি সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া লেবাননে গত বছর ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৫০০ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের কঠোর নিন্দা ও আহ্বান
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস বলেছেন, “ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর এত মাত্রায় সহিংসতা সত্যিই মর্মান্তিক।” তিনি আরও বলেন, “জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরক অস্ত্রের ব্যবহার ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।” গুতেরেস আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার এবং বিশেষ করে শিশুদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি উল্লেখ করেছেন, “স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সুরক্ষিত স্থানগুলোকে অবশ্যই হামলা থেকে রক্ষা করতে হবে এবং সামরিক অভিযানে সাধারণ জনগণের ক্ষতি কমানো অত্যাবশ্যক।”
ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ও হামাসের কালোতালিকা
ইসরায়েলের জাতিসংঘ মিশন এখনও এই রিপোর্টের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এছাড়া ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আল-কাসেম ব্রিগেডস এবং ইসলামিক জিহাদের আল-কুদস ব্রিগেডসকেও দ্বিতীয়বারের মতো কালোতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্বে শিশুদের ওপর সহিংসতার অন্যান্য ঘটনাও উদ্বেগজনক
২০২৪ সালে গাজার বাইরে কঙ্গো, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, হাইতি প্রভৃতি দেশে শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। কঙ্গোতে প্রায় ৪ হাজার, সোমালিয়ায় ২ হাজার ৫০০, নাইজেরিয়ায় ২ হাজার ৫০০ এবং হাইতিতে ২ হাজার ২০০টির মতো গুরুতর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
সহিংসতা বৃদ্ধির শতকরা হার সবচেয়ে বেশি লেবানন (৫৪৫%), মোজাম্বিক (৫২৫%), হাইতি (৪৯০%), ইথিওপিয়া (২৩৫%) এবং ইউক্রেনে (১০৫%) দেখা গেছে।
গাজার সংকট: এক মানবিক বিপর্যয়
গাজায় চলমান সংঘাত শুধু ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবন-জীবিকা বিনষ্ট করছে না, বরং পুরো অঞ্চলের মানবিক সংকটও ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস, স্বাস্থ্য সেবা ব্যাহত, এবং বেসামরিক বসতিগুলোতে হামলার ফলে অসংখ্য শিশুর মনোবিকাশ ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়েছে।
শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ায় শিশুদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় বিশাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে জাতিসংঘের আহ্বান হলো, শিশুদের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির উর্ধ্বে উঠে মানবিক চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। সংঘর্ষকালীন সময়ে শিশুদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ ও মনিটরিং প্রয়োজন।
ইসরায়েলের গাজায় শিশুদের ওপর নির্বিচার সহিংসতা জাতিসংঘের রিপোর্টে পুনরায় উঠে আসায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিশুদের জীবন রক্ষা ও শান্তির জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি।